আড্ডাপত্র

৬ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১; ২১ নভেম্বর, ২০২৪;দুপুর ১২:২৯

রিভিউ | শাহাদুজ্জামান এর ‘লেখা নিয়ে কথা’

আড্ডাপত্র

এপ্রি ১৮, ২০২১ | বই

গ্রন্থ- লেখা নিয়ে কথা
লেখক- শাহাদুজ্জামান
প্রকাশকাল- ফেব্রুয়ারি ২০২০ইং
প্রচ্ছদ- ধ্রুব এষ
প্রকাশক- ঐতিহ্য
মূল্য- ২৮০ টাকা
পৃষ্ঠা সংখ্যা- ১৫২

পাঠ মূল্যায়ন: সাকি সোহাগ

‘লিখতে হলে তো পড়াটা বাধ্যতামূলক। একটা ভালো লাইন লিখতে হলে একশটা ভালো লাইন পড়তে হয়। পড়তে পড়তেই সাহিত্যের ভালো মন্দের বোধটা তীক্ষ্ণ হয়। সাহিত্য করতে হলে শুধু সাহিত্য পড়লে লাভ নাই। আমি মনে করি একজন লেখককে বিশ্ব ভাবুক হতে হবে। রাজনীতি, ইতিহাস, দর্শন, আর বিজ্ঞানের প্রধান ভাবনাগুলোর সাথে পরিচয় থাকা খুব জরুরি। লেখক রসকা-ের মানুষ কিন্তু জ্ঞানকাণ্ডে তার বিচরণ থাকা উচিত। পন্ডিত হওয়ার দরকার নেই কিন্তু বিশ্ব ভাবনার মূল প্রবণতাগুলো সম্পর্কে একটা ধারণা থাকা দরকার, তাতে দৃষ্টিটা স্বচ্ছ হয়। এতে করে বোকা বোকা লেখার ঝুঁকি কমে আসে।’

কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের লেখালেখি নিয়ে তরুণ প্রজন্মের লেখক, সাহিত্যানুরাগীদের মাঝেমাঝেই কথোপকথন হয়েছে। সেই কথোপকথনগুলোকে একত্র করা হয়েছে শাহাদুজ্জামানের গত ২০২০ইং সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত ‘লেখা নিয়ে কথা’ গ্রন্থে। এই গ্রন্থটি মূলত একটি সাক্ষাৎকার কেন্দ্রিক গ্রন্থ। এখানে শাহাদুজ্জামান তাঁর নিজের লেখা নিয়ে অনেকের সাথেই কথা বলেছেন। বলেছেন নিজের লেখালেখির ভেতরের গল্প নিয়ে। লেখালেখির পিছনের গল্প নিয়ে। সেই সাথে উঠে এসেছে তাঁর জীবনেরও একটুকরো গল্প।

২০১৬ সালে কথাসাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত শাহাদুজ্জামান ছোটবেলায় স্কুলে পড়াকালীন দু’একটা কবিতা লিখছেন। কিন্তু ওই পর্যন্তই রয়ে গেছে তাঁর কবিতা লেখা। তবে তিনি বাংলা কবিতার অন্ধ এক পাঠক। কবিতার বই তিনি পাগলের মতো পড়েন। সেই সূত্রে বলা যায় তাঁর কিছু গল্পে কবিতার ছায়াও আছে। যা তিনি নিজেও স্বীকার করেছেন যে, ‘এক কাঁঠাল পাতা আর মাটির ঢেলার গল্প’টি পাঠ করলে কবিতার মতোই শোনাবে।

তার লেখালেখির শুরুটা হুট করেই। কোনদিন ভাবেননি তিনি লেখক হবেন। কথাসাহিত্য নিয়ে কাজ করবেন। তার বাবাও কবিতা লিখতেন। ছোটবেলায় দেখতেন তার বাবা ডাইরিতে কবিতা লিখছেন। পরবর্তী সময়ে বাবার লেখা কবিতাগুলো বাবা ডেকে শোনাতেন। তার মা’ও সাহিত্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। তাই বলা যায় সেখান থেকেই তার সাহিত্যের প্রতি একটা ঝোঁক তৈরি হয়।তারপর চট্টগ্রাম মেডিকেলে পড়ার সময় তিনি সাহিত্যে একেবারে জড়িয়ে যান।

১৯৬০ সালে ঢাকায় জন্ম নেওয়া এই কথাসাহিত্যিক বড়ই অস্থির প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ থেকে পাশ করে চট্টগ্রাম মেডিকেলে পড়ার সুযোগ পান। সেখানে পড়তে গিয়ে তিনি জীবনকে গুলিয়ে ফেলেন। একবার অনুবাদ লেখা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে অন্যবার থিয়েটার নিয়ে। আবার ফিল্মের দিকেও এক সময় ঝুঁকে পড়েন। শাহাদুজ্জামান গ্রুপ থিয়েটারে যুক্ত ছিলেন। ছিলেন চট্টগ্রাম ফিল্ম সোসাইটির জেনারেল সেক্রেটারিও। তিনি গান বাজনা, নাটক, আবৃত্তি, বিতর্কের সাথে সিরিয়াসভাবে লেগে পড়লেন। সেসময় তিনি কখন কী করছেন ঠিক নেই। হুট করে দাবা খেলায় ঝুঁকে গেলেন। এবং তিনি দাবা খেলে অনেক বড় একটা জায়গাতেও পাড়ি জমালেন। তিনি যখন বুঝতে পারলেন ডাক্তারি করে লেখালেখির সময় তেমন পাওয়া যাবে না। তখন তিনি ভালো করে খুঁজতে লাগলেন যে লেখালেখি করে এমন কোন ডাক্তার আছে কিনা? সেই খোঁজেই বের হয়ে আসলেন আশি-নব্বই দশকে সিরিয়াসভাবে লেখালেখি চর্চা করা ডাক্তার মামুন হুসাইন, জাকির তালুকদার, ময়মনসিংহের তসলিমা নাসরিন। তবুও উনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন যে, উনি ডাক্তারি পড়বেন না। বরং সাহিত্য সাংস্কৃতিক কোন বিষয় নিয়ে পড়বেন। আর যখন এটা উনার বাবা জানলেন, তখন উনি শাহাদুজ্জামানকে বললেন- ‘ডাক্তারি তোমাকে করতে হবে না। তুমি শুধু ডিগ্রিটা নাও।’ বাবার কথা শুনে বছর গ্যাপ দিয়ে শাহাদুজ্জামান আবার মেডিকেলে মন বসান। তিনি পাশ করার পর মেডিকেল পাশের সনদ খামে পুরে বাবাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

১৯৯৬ সালে প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘কয়েকটি বিহ্বল গল্প’ এর জনপ্রিয় লেখক শাহাদুজ্জামান ‘লেখা নিয়ে কথা’ গ্রন্থে অনেক গভীরে কথা বলে গেছেন। যা বর্তমান তরুণ ও নবীন লেখক প্রজন্মের জন্য কাজে আসতে পারে বলে মনে করা হয়। ‘লেখা নিয়ে কথা’ গ্রন্থে তিনি ‘কথা- এক’ বলেছেন গল্পকার অলাত এহ্সান এর সাথে। কথা বলার এক পর্যায়ে অলাত এহ্সান বলে উঠলেন-
দেশের রাজনৈতিক দর্শন চর্চার চেয়ে দলীয় চর্চার প্রবণতা বেশি। এটা সাহিত্যের জন্য ক্ষতি ঘনিয়ে এনেছে বললে শাহাদুজ্জামান বলে উঠেন-
‘দলীয় রাজনীতি লেখকের জন্য অবশ্যই ক্ষতিকর। লেখককে এমন জায়গায় দাঁড়াতে হয়, যেখান থেকে অবাধে সে কোন কথা বলতে পারার ক্ষমতা রাখে। দলের ভেতর থাকলে তো সেই স্বাধীনতা থাকবার কোনো উপায় নেই। একসময় বাম দলগুলো লেখক শিল্পীকে দলীয় কাঠামোর ভেতর আনতে বাধ্য করতে চাইত। এ নিয়ে বাম রাজনৈতিক দল আর লেখক শিল্পীদের ব্যাপক বিরোধ হয়েছে।’

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বাপর নাটকীয় সময়কালের উপন্যাস ‘ক্রাচের কর্নেল’ এর এই লেখক ‘লেখা নিয়ে কথা’ গ্রন্থের এক সাক্ষাৎকারে বলেন- ‘জীবনের অনেক কাজের মতোই সাহিত্য একটা কাজ। অনেক লেখককে দেখেছি লেখা ছাড়া অন্য কাজকে নীচু করে দেখতে। তারা মনে করেন যে কাজ এ্যাবস্ট্রাক্ট না সেটা কোনো কাজ না। তাহলে তো কৃষকের কাজ কোনো কাজই না। আমি এ কথাটাই বলতে চাই যে সাহিত্যের কাজটাকে মহান এক কর্মকা- ভেবে, জীবনের অন্য সব মাত্রাকে ছোট করে দেখলে লেখক জীবনটাও ভারসাম্য হারাবার সম্ভাবনা থাকে। মৌমাছি অনেক সময় নিজের তৈরি মধুতেই ডুবে মরে।’

শাহাদুজ্জামানের লেখাগুলো একটু ভিন্ন আঙ্গিকে লেখা। বর্তমানের প্রেক্ষাপটকে লেখার প্লটে হাজির করে লেখাগুলোকে করেছে আরও আকর্ষণীয়। বর্তমান বাংলাদেশে তার একটা বৃহৎ পাঠক সমাজ তৈরি হয়েছে। যদিও অবাক হতে হয় যে, শাহাদুজ্জামান আজ অবধি কাউকে তাঁর বইয়ের ভূমিকা লেখার জন্য অনুরোধ করেনি। তাঁর বইয়ের কোন মোড়ক উন্মোচন হয়নি। হয়নি কোন বিক্রির প্রচারণা। তিনি কাউকে কোনদিন বলেনি যে তাঁর বইটাকে নিয়ে আলোচনা লিখতে। এগুলো তিনি সচেতনভাবে এড়িয়ে গেছেন। যদিও তাঁর বইয়ের প্রচার, পাঠক-পাঠিকা তৈরিতে বিশেষ কোন সমস্যা হয়নি।

চিকিৎসা নৃবিজ্ঞানে পিএইচডি অর্জন করা এই লেখক লেখালেখির অনেকটা সময় ব্যয় করেছেন জীবনানন্দ দাশকে মস্তিষ্কে রেখে। ক্যাডেট কলেজে পড়াকালীন সময়ে বাংলা শিক্ষক রফিক কায়সার জীবনানন্দ দাশের ‘আট বছর আগে একদিন’ কবিতাটি আবৃত্তি করলে শাহাদুজ্জামানকে তাৎক্ষনিক দখল করে নেয় কবিতাটি। সেই কৈশর থেকেই জীবনানন্দ দাশ তাঁকে ভর করছিল। আর সেখান
থেকেই জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে ভাবাভাবি শুরু। এবং দীর্ঘ ভাবার পর জীবনানন্দ দাশকে উপজীব্য করে তিনি একটি উপন্যাস লিখলেন ‘একজন কমলালেবু’। উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশ প্রথম আলোর ঈদসংখ্যাতে হলেও পরের বছর ২০১৭ সালে বই আকারে বের হয় প্রথমা প্রকাশন থেকে। ‘একজন কমলালেবু‘ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে গ্রন্থের লেখক শাহাদুজ্জামান বলেন-
‘আসলে লেখা তো একটা অর্গানিক প্রক্রিয়া, লিখতে লিখতেই আমার নিজের কাছে ¯পষ্ট হয়ে উঠছিল এই বই নিয়ে আমার যাত্রার পথ। আমার মনে হচ্ছিল, ফর্মের নিরীক্ষা করে একধরনের ইন্টোলিকচুয়াল এক্সারাসাইজ হয় বটে, কিন্তু সেটা এই বইয়ের মূল উদ্দেশ্যকে বিশেষ সাহায্য করে
না।’

বর্তমান যুক্তরাজ্যের সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক শাহাদুজ্জামানের লেখালেখির কলা কৌশল একটু অন্যরকম। তিনি যাই লেখা শুরু করতেন, সেটা লেখা শেষ হলে ছাপাবার আগেই তাঁর কাছের মানুষদের পড়াতেন এবং উনাদের মতামত নিতেন। এতে করে লেখার কোন সমস্যা থাকলে তা ছাপানোর আগেই ধরা পরতো। এটা অনেক বড় একটা পাওয়া নয় কি?

শাহাদুজ্জামানের উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়াছে, ক্রাচের কর্নেল; একজন কমলালেবু; অন্য এক গল্পকারের গল্প নিয়ে গল্প; মামলার সাক্ষী ময়না পাখি; কথা পর¯পরা; একটি হাসপাতাল, একজন
নৃবিজ্ঞানী, কয়েকটি ভাঙা হাঁড়ি ও লেখালেখি নিয়ে কথা ইত্যাদি।

ঐতিহ্য প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘লেখা নিয়ে কথা’ গ্রন্থে লেখক শাহাদুজ্জামান অনেক গুরুত্বপূর্ন কথা বলে গেছেন। তারমধ্যে ‘কথা-চার’ এ তিনি কথা বলেছেন কবি এবং গল্পকার সুমন রহমানের সাথে। সেখানে কথা বলার এক পর্যায়ে শাহাদুজ্জামান বলে ওঠেন-
‘তো যে কথা বলছিলাম গল্প লেখা আমার কাছে বড় কথা না, বড় কথা হচ্ছে আমি আমার ভেতরের কথাগুলো এক্সপ্রেস করতে পারছি কিনা। আমার জীবনের অভিজ্ঞতা, আমার ভেতরের প্রশ্নগুলো গল্পে নাড়াচাড়া করতে পারছি কিনা সেটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ন। এবং গল্প বলা মানে কাহিনী বলা না।’

Facebook Comments

আড্ডাপত্রে লাইক দিন

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১১৩১৫১৬
১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭৩০