তূয়া নূর
[আজ ২২ নভেম্বর , বাংলা ভাষার অন্যতম কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন এর জন্মদিন। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বহুদেশে বহু ভাষায় অনূদিত হয়ে তাঁর কবিতা পঠিত হচ্ছে।তিনি মঞ্চ ও টিভি উপস্হাপকও বটে। তাঁর পিতার নাম শেখ বোরহানউদ্দিন আহমেদ।মাতা-রেবেকা সুলতানা।জন্মস্হান-যশোর।গ্রাম-নলভাঙা।অর্থনীতিতে স্নাতক সম্মান।রাষ্টবিজ্ঞানে এম এ। নজরুল ইন্সটিটিউটের সাবেক উপ পরিচালক। কৈশরেই লেখালেখি শুরু।১৯৭০সালে যশোর থেকে প্রকাশিত শতদল পত্রিকায় প্রথম ‘শপথ’ নামে কবিতা প্রকাশ।মোট গ্রন্হ১০১।কাব্যগ্রন্হ ৬৫।উল্লেখ্যোগ্য-ফিরিনি অবাধ্য আমি।ভেঙে আনো ভেতরে অন্তরে।সেইসব ছদ্মবেশ। আঙুলের জন দ্বৈরথ। হিংস্র নৈশভোজ। ভাঙা দালানের স্বরলিপি।সবজন্মে শত্রু ছিলো যে।জ্যামিতি বাক্সের গল্প।তদন্তরিপোর্ট। অবুঝ যাদুঘর।প্রতিবিদ্যা। ছড়াগ্রন্থ: হা্ঁটতে থাকো।শৈশব। চিরশিশু। গদ্যগ্রন্থ: রবীন্দ্রনাথ আরোগ্য।নজরুলের আত্ম নৈরাত্ম। নির্বাসিত তারুণ্য। কাঠ কয়লায় লেখা। কবিতা অনূদিত হয়েছে-ইংরেজি।হিন্দী। উর্দু।হিন্দী। উড়িয়া।স্পেনিশ।গ্রিক। রোমানিয়ান।ফরাসী। জাপানি। নেপালি। সুইডিশ। রুশ সহ২১টি ভাষায়। ভিডিও সিডি১০টা।আবৃত্তিএ্যালবাম-৬টা।প্রদীপ ঘোষের কন্ঠে আবৃত্তি এ্যালবাম-আবার একদিন বৃষ্টি হবে। পুরস্কার ও সম্মাননা: বাংলা একাডেমি পুরস্কার; মাইকেল মধুসূদন পুরস্কার; দার্জিলিং নাট্যচক্র সম্মাননা; সব্যসাচী পুরস্কার (ভারত); সেন্টার ফর স্টেজ সম্মাননা (পশ্চিমবঙ্গ; )সিটি আনন্দ আলো পুরস্কার; খুলনা রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার; ধারা সাহিত্য আসর পুরস্কার; তরঙ্গ অফ ক্যালিফোর্নিয়া সম্মাননা; লসএন্জ্ঞেলস বাদাম সম্মাননা; লসএন্জেলস রাইটার্স ক্লাব সম্মাননা; ইংল্যান্ড জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন সম্মাননা। সম্পাদিত পত্রিকা: রৌদ্রদিন।পদাবলি। দেশভ্রমণ: ভারত।নেপাল।দুবাই।আমেরিকা।ইংল্যান্ড। চীন। তার কবিতা নিয়ে আজ আলোকপাত করেছেন তরুণ কবি তূয়অ নূর।]
একজন কবি একটা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে জন্মগ্রহণ করে ঠিকই। কিন্তু তার লেখা শুধু মাত্র সেই ভূখণ্ডের মানুষের জন্য না সীমিত থাকে না। তার লেখায় যে মানবিক প্রেম, সংহতি ও সাহস জাগানোর যে সবল উচ্চারণ থাকে তার সারা পৃথিবীর মানুষের জন্য। মানুষ পায় সেই লেখা থেকে অনুপ্রেরণা। কবিতা ভাষা নির্ভর। এক জনগোষ্ঠীর ভাষা অন্য অন্য জনগোষ্ঠীর কাছে বোধগম্য না যেমন বোধগম্য চিত্রশিল্প। অন্য জনগোষ্ঠীর কাছে আজ ভাষার সীমাবদ্ধতা ভেঙে অনুবাদ হয়ে পৌঁছে যাচ্ছে কবিতার মর্মবাণী।
কবি রেজাউদ্দীন স্টালিন সমসাময়িক বাংলাদেশ অন্যতম উজ্জ্বল ও জনপ্রিয় মুখ। পরিশ্রমী এই কবি এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য তৈরি করতে পেরেছেন তার কবিতায়। সময়ের সাথে পরিবর্তন এসেছে তার কবিতায়। পাল্টেছে ফর্ম। তবে এই ফর্ম একই সময়ে বার বার তিনি ব্যবহার করেন নি। বিভিন্ন ফর্মে উপস্থাপন করেছেন কবিতা।। একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, কোন তার কোন কবিতা উদ্দেশ্যহীন নয়। সব কবিতায় একটা বক্তব্য উঠে এসেছে।
কবি রেজাউদ্দিন স্টালিনের লেখার বিষয় অবারিত। কোন গণ্ডীতে তিনি আবদ্ধ নন। দেশ সমাজ প্রকৃতি তেমনি বাইরের পৃথিবীর কোন বিষয় বাদ যায়না তার কবিতায়। কবিতার সব শাখায় তার সমান এবং অবাধ বিচরণ।
কবি বাল্মীকি একটা তীরবিদ্ধ বক দেখে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। কবিতা বের হয়ে এসেছিলো তাঁর মুখ থেকো। আজো পৃথিবীতে ঘটে অসংখ্য ক্ষুব্ধ হবার মতো ঘটনা। বিভিন্ন ধরণের বৈষম্য অনেক সমাজে বিরাজমান।আবার অনেক সমাজে মাঝে মাথা তুলে দাঁড়াতে চায়। সম্প্রতি এমন একটা ঘটনা মানব সমাজকে হতবিহব্বল করে দেয়। কবি তখন বললেন,
উইপোকার পেটে তলিয়ে যাচ্ছে শ্বাস বাক্স
ঈশ্বরের আসতে দেরি হবে
ফ্লয়েড তুমি যাত্রা শুরু করো
স্বর্গ দূরের পথ
রক্ত গড়ানো আকাশের ড্রেনে বুটের বুদ্বুদ
নীল ঘোড়ার হ্রেষা
নির্জনতা নেমে আসছে মেনিসোটায়
পৃথিবীর সব ২৫ মে শুয়ে আছে ফুটপাতের জিহ্বায়
(আত্মার ইতিহাস)
গ্রীক, রোমান, মিসরীয়, আরবীয় ও ভারতীয় মিথ নিয়ে পড়াশুনা করেছেন কবি। মিথের প্রতি দুর্বলতা সব কবি ও গল্পকারের ভেতর দেখা যায়। মিথ শুধুমাত্র পৌরাণিক কাহিনী নয়। মিথে আছে যেমন যুদ্ধ ও ক্ষমতার লড়াই, তেমনি আছে ভালোবাসা ও মানবিকতা। হোমারের মতো চারণ কবিদের কাছে তা সাহিত্য হয়েছে উঠেছে। মিথ যেন মানুষের জীবনেরই কথা, বর্ণনা পেয়েছে রূপকথার আদলে। কবি স্টালিনের অনেক কবিতায় এসেছে মিথ। ব্যবহার করেছেন যথার্থ ভাবে, যা কবিতার বক্তব্য কে দৃঢ় করেছে। কোন কোন কবিতা তিনি গ্রীক, রোমান, ভারতীয় ও অন্যান্য মিথ একসাথে গেঁথেছেন কবিতায়। তাতে কবিতা আরো বেশী অর্থময় উঠেছে—
জীবনের নিজস্ব নদী আছে
বালি ও শামুক
প্রতিটি ঢেউয়ের বাঁকে ভাঙনের স্বর
তাকে চিনি প্রথা ছেঁড়া আগুনের পাখি
প্রবাল দুঃখ থেকে জেগে ওঠা দারুচিনি দ্বীপ
সর্বনাশ চোখে নিয়ে বসে থাকা দগ্ধ একিলিস
(দগ্ধ একিলিস)
তার কবিতা সব ধরণের পাঠকের জন্য। সরল ভাবে পড়ে কবিতার কথা বোঝা যায়। আবার যে পাঠক গভীরে যেতে চায় তার জন্য রয়েছে পড়াশুনা ও অনুসন্ধানের অবকাশ। কবিতার সাথে তারও পড়া হয়ে যাবে ইতিহাস ও বিভিন্ন মিথ। ‘কতদূর ইথাকা’ কবিতায় তিনি বললেন—
অনেকদূর হেঁটে এসে পেছনে তাকালে
আর বাড়ি দেখা যায় না
দৃষ্টির সূর্যপথ উঠে যায় মেঘবৃক্ষে
পেছনে কার বাড়ি
চণ্ডীদাসের নাকি কাহ্নপার
জ্ঞানদাস একবার বিদ্যাপতির নিমন্ত্রণে এসে
পথ হারিয়ে বহুদিন আলাউলের অতিথি ছিলেন
আর কালিদাসের আমন্ত্রণ সত্ত্বেও
যেতে পারেননি মোহাম্মাদ সগীর……।
বিজ্ঞান জানলে কবিতা লেখা সহজ হয়। কবিতায় বৈচিত্র্য আনা যায়। ইতিহাস না জেনে কবিতা লেখা যাবে না। আর ‘কোন এক কালে পড়েছি’ বলে পার পাওয়া যাবে না। ক্রমাগত ইতিহাস চর্চা যেমন প্রয়োজন, তেমনই প্রয়োজন নতুন তথ্যে নিজেকে পূর্ণ করা। ইতিহাস সচেতন কবি লিখলেন—
এক নাইটিংগেল
বুকের রক্তে ফুটিয়েছি রক্তের নীল গোলাপ
আমি জ্বলছি জন্ম আমি মাতাহারি থেকে
তবু পরাজিত হইনি কখনো
এমনকি এই পাতানো মৃত্যুমঞ্চেও না
বরং বিচারের পরাকাষ্ঠায় দাঁড়িয়ে
হেসে উঠছি হা হা -পৃথিবী দেখুক
নগ্ন আদিম স্তনের অন্ধকারে
উদ্ধত নিরাপোষ এক নারী
মাতাহারি
(আমি মাতাহারি)
একটা দেশ স্বাধীন হয় অনেক ত্যাগের বিনিময়ে। তার ভাষা, অধিকার, সামাজিক সাম্য, গণতন্ত্র সব কিছু কখনো কখনো চড়া দামে কিনতে হয়। ইংরেজিতে একটা প্রবচন আছে ‘Freedom is not free’। কষ্টে পাওয়া জিনিষ গুলো আমরা অবহেলায় হারিয়ে ফেলি। কোন কিছুই কবিদের চোখ ফাঁকি দিতে পারে না। হয়তো অনেকে চোখ বুজে থাকে। অনেকে না দেখার ভান করে। অনেকে বলে। সরাসরি না বলতে পারলেও রূপক করে বলতে পারাটাও কম নয় প্রতিকূল সময়ে। কবি কথার কষাঘাত দিয়ে সচেতন করার চেষ্টা করেছেন—
সব ছুঁড়ে ফেলে আমরা নন্দলাল হলাম
চিনিয়ে দিলে অমৃত
আমরা পাতাল সেঁচে নিয়ে বিষ নিয়ে এলাম
তুমি এনে দিলে স্বাধীনতা
আমরা প্রেমে পড়লাম পরাধীনতার
(বৈপরীত্য)
আরেক কবিতায় তিনি বললেন—
বন পেরলেই তেপান্তর,
অদূরে এক লোহার ঘর।
রাজকুমারীর মৃত্যুঘুম,
ভাঙিয়ে দেবে রাজকুমার।
জিয়নকাঠি-মরণকাঠি,
জাগবে দেশ দেশের মাটি।
(জীয়নকাঠি)
তার কবিতায় আছে গভীর জীবনবোধ। এই জীবনবোধ তাকে একাত্ম করেছে পাঠকের সাথে—
এতো হত্যা দুঃখদাগ
জন্ম তবে কেন দরকারি,
কারো কর্ম দায়ভাগ
নেবেন কি উত্তরাধিকারী?
জীবিত জিজ্ঞেস করে
মৃত্যুর পরের সরণি,
আর জানলে কী করে তুমি এখনো মরোনি?
(গোপনীয়তা)
সব কবির ভেতর জীবন-যন্ত্রণা বিদ্যমান যা তাকে নিরন্তর তাড়িত করে। জীবনের দর্শন একেক কবির কাছে একেক রকম হলেও কষ্টবোধটা এক। মানুষ বার বার চেষ্টা করে তার কষ্টের কথাটা বলার। যে কবি যত বেশী সহানুভূতিশীল হয়ে এই কষ্টের কথা গুলো বলতে পারে, সে হয় মানুষের প্রিয় জন। মানব জীবনের প্রেম,স্বপ্ন, আশা, সুখ দুঃখ তিনি সংজ্ঞায়িত ও বিশ্লেষণ করেছেন তাঁর কবিতায়—
জীবন এক পুড়ে যাওয়া প্রতিবিম্ব
আর মৃত্যু চা-পাতার ঘোড়া
টগবগ করছে দরোজার ডেকচিতে
প্রেম-এক প্রযুক্তি যা উৎপাদন করে অদৃশ্য জানালা
স্মৃতি-অদ্ভুত পাঠাগার যার বই পড়ে দীর্ঘশ্বাস
স্বপ্ন-ফেলে আসা জাদুঘর যেখানে
হাওয়ার হামলায় লুকিয়ে থাকে বর্ষাতি
আশারা-ময়ূর পালকে স্থাপিত
আর্গাসের শত শত-চোখ
এই কবিকে অভিনন্দন।