[সরদার ফজলুল করিম এর সাড়াজাগানো ‘দর্শনকোষ’ প্রথমে বাংলা একাডেমী পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় ১৯৬৮ সালে। পর্ববর্তীতে বাংলা একাডেমী গ্রন্থাকারে বের করে ‘দর্শনকোষ’। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। ১৯৭৩, ৮৬ ও ৯৫ সালে বের হয় তিনটি সংস্করণ। এরপর অন্যান্য প্রকাশনী থেকেও ‘দর্শনকোষ’ বের হয়। গত অর্ধশতাব্দীকাল ধরে ‘দর্শনকোষ’ এর গুরুত্ব এতটুকু কমেনি। বরং এর পাঠক সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। পাঠকের চিন্তাকে নাড়া দিতে দার্শনিক সরদার ফজলুল করিম এর অবদান অপরিসীম। তাঁর দর্শনকোষ আড্ডাপত্র’র পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হচ্ছে ধারাবাহিকভাবে]
Acosta, Uriel: উরিয়েল এ্যাকোস্টা (১৫৮৫-১৬৪০ খ্রি.)
ওলান্দাজ দার্শনিক। জন্ম পর্তুগাল, ১৫৮৫ কিংবা ১৫৯০ খ্রিষ্টাব্দে। মৃত্যু ১৬৪০ খ্রিষ্টাব্দে। প্রথম জীবনে ক্যথলিক শিক্ষায় শিক্ষিত হন। কিন্তু যুক্তিবাদকে নিজের দর্শন হিসাবে গ্রহণ করে পরবর্তী কালে ক্যাথলিক ধর্ম পরিত্যাগ করে ক্যাথলিক নির্যাতনের ভয়ে ১৬১৪ খ্রিষ্টাব্দে হল্যাণ্ডে পালায়ন করেন। এই পর্যায়ে উরিয়েল এ্যাকোষ্টা ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু মূল ইহুদি ধর্মের ভাবধারাসমূহকে ইহুদি যাজক সম্প্রদায় বিকৃত করেছে বলে তিনি ইহুদি যাজক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করেন। ১৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে আত্মার অবিনশ্বরতার উপর ‘sbre a martali dade da alam do homen’ নামক গ্রন্থ রচনা করেন এবং দাবি করেন যে, দেহের মৃত্যুর পরে আত্মার অবিনশ্বরতা বলে কিছুই নাই। সনাতন মতের বিরুদ্ধচারণের জন্য উরিয়েল এ্যাকোস্টাকে ইহুদি সমাজ থেকে দু দুবার বহিস্কার করা হয়। একদিকে ইহুদি যাজক সম্প্রদায় এবং অপরদিকে ওলন্দাজ সরকারের নিগ্রহে উরিয়েল এ্যাকোস্টা আত্মহত্যা করেন। তাঁর অপর গ্রন্থের নাম ছির ‘Exemplar humane vitae’ এই পুস্তকে তিনি রাষ্ট্রীয় ধর্ম, ইহুদি এবং খ্রিষ্টান, সমস্ত ধর্মীয় বিশ্বাসের বিরোধিতা করেন। সপ্তদশ শতকের বিখ্যাত ওলন্দাজ দার্শনিক স্পিনোজা উরিয়েল এ্রাকোস্টার মতবাদে বিশেষ প্রভাবিত হয়েছিলেন। লেখক ক. এফ গুজকাউ-এর বিষদাত্মক নাটক ‘উরিয়েল এ্যাকোস্টা’ (১৮৪৭) উরিয়েল এ্যাকোস্টার জীবন-কাহিনীর ভিত্তিতে রচিত।
Activists: কার্যবাদী, ক্রিয়াবাদী
রাজনৈতিক দলের মধ্যে লক্ষ্য সাধনের ক্ষেত্রে মতামতের পার্থক্যের উদ্ভব হয়। এরূপ মতামতের যদি কোনো উপদল দলের লক্ষ্য সাধনের জন্য প্রত্যক্ষ সংগ্রাম বা কার্যের উপর অধিক জোর দেয় তবে তাদেরকে কার্যবাদী বা ক্রিয়াবাদী বলা হয়।
Activity: ক্রিয়া
মনোবিজ্ঞানে, মানসিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। দশরএনর ব্যক্তির উদেশ্য সাধনার্থে গৃহীত কর্মবাদ বা প্রাগামেটিজমের তত্ব।
মনোবিজ্ঞানে ব্যক্তি এবং বস্তুর পাস্পারিক সম্পর্ক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ব্যক্তি বস্তু বা পরিবেশকে ক্রিয়ার মাধ্যমে নিজের চাহিদা পূরণের উদ্দেশ্যে নিয়ন্ত্রিত করার প্রয়াস প্রায়। জীবনমাত্রেরই একটি স্বাধীন ক্রিয়ার ক্ষমতা আছে। কিন্তু সকল জীবের ক্ষেত্রে ক্রিয়ার স্বাধীনতা এবং বিকাশের স্তর সমান নয়। এজন্য প্রাথমিক ধরনের ক্রিয়া এবং জটিল উচ্চতর ধরনের ক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য করা হয়। মনুষ্যেতর জীবেরও কার্যক্ষমতা আছে। কিন্তু মনুষ্যেতর জীবের ক্রিয়ার মধ্যে মানুষের তুলতায় স্বাধীনতার পরিচয় কম। মনুষ্যেতর পশু-পক্ষীর ক্রিয়াকে পরিবেশই অধিক পরিমানে নিয়ন্ত্রিত করে। মানুষ পরিবেশ দ্বারা কেবল নিয়ন্ত্রিত হয় না; পরিবেশকে নিজের উদ্দেশ্য সাধনে পরিবর্তিত করার জন্যে আপন মস্তিস্ক এবং ইন্দ্রিয়াদির সাহায্যে বিশেষ বিশেষ ক্রিয়াকাণ্ড সম্পন্ন করে। মানসিকভাবে উদ্দেশ্য থাকা বা উদ্দেশ্যের সৃষ্টি করা কেবলমাত্র মানুষের ক্ষেত্রেই জটিল এবং উন্নতভাবে প্রকাশিত হতে দেখা যায়। ক্রিয়া কথার মধ্যে একটি সামাজিক অর্থ নিহত আছে। কোনো ব্যক্তি অপর ব্যক্তি-বিচ্ছিন্নভাবে কোনো কিছুর সঙ্গেই সম্পর্কিত নয়। ব্যক্তির অর্থ সামাজিক পরিবেশের ব্যক্তি। সে কারণে ব্যক্তির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার পেছনে সামাজিক পরিবেশ এবং উক্ত পরিবেশের বিশেষ অবস্থা বিদ্যমান। মানুষের আদিতেও ব্যক্তির ক্রিয়া সামজিক পরিবেশের চাহিদা থেকেই শুরু হয়েছে। জৈবিক চাহিদা পূরনের জন্য প্রয়োজনীয় কর্ম ব্যক্তি অপর ব্যক্তির সমষ্টিগতভাবে গ্রহণ করেছে। মস্তিস্ক চালনার ক্ষেত্রে মনুষ্যেতর জীবের তুলনায় মানুষ অধিকতর জটিল এবং স্বাধীনতা চরম মনে করা ভূল। সামাজিক পরিবেশ-নিরপেক্ষভাবে ব্যক্তি কেবলমাত্র মস্তিৃস্কের ইচ্ছানুযায়ী কোনো ক্রিয়া-কাণ্ডের সূত্রপাত করতে পারে না। এদিক থেকে ব্যক্তি পরিবেশ-নিয়ন্ত্রিত। ব্যক্তি ও পরিবেশের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্পর্ক দ্বন্দ্বমূলক এবং পরস্পর-নির্ভরশীল। কেউই চরমরূপে স্বাধীন নয়।
মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ক্রিয়া দুরকম হতে পারে। অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক। বাহ্যিক ক্রিয়ায় ব্যক্তি নিজের ইন্দ্রিয় সহযোগে বস্তুর উপর সক্রিয় হয়। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ব্যক্তি বস্তুর মানসিক স্মৃতি ও ছবির উপর কল্পনার মাধ্যমে ক্রিয়াশীল হয়। যে-কোনো বাহ্যিক ক্রিয়ার পূর্বে ব্যক্তি তাকে মানসিকভাবে পূর্বেই সম্পন্ন করা চেষ্টা করে। মুখে যে শব্দ উচ্চারণ করে অপর ব্যক্তির নিকট আমরা ভাব প্রকাশ করি, সে শব্দকে মানসিকভাবে প্রায়শই আমরা পূর্বে উচ্চারণ করে নিই। এরূপ ক্রিয়ার পৌনঃপুনিক চেষ্টায় মানসিক ক্রিয়া ক্রমান্বয়ে স্বয়ংক্রিয় বা মনেরও অগচরে হয়ে দাঁড়ায়। মানসিক ক্রিয়া পরিবেশকে পরিবর্তন করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। মানসিক ক্রিয়াই তত্ব হিসাবে প্রকাশিত হয়। তত্ব ও তার প্রয়োগমূলক ক্রিয়াও পরস্পর নির্ভরশীল। পরিবেশের আঘাত মস্তিস্ককে উপযুক্তরূপে পরিবর্তনের চিন্তায় সক্রিয় করে। মানসিকভাবে পরিকল্পিত ক্রিয়াকৌশল পরিবেশের উপর প্রয়োগের মারফত ব্যক্তি তার বাঞ্ছিত উদ্দেশ্য বাস্তবক্ষেত্রে কার্যকর করতে প্রয়াস পায়।
Adler, Alfred: আলফ্রেড এ্যাডলার (১৮৭০-১৯৩৮)
অষ্টিয়ার মনোবিজ্ঞানী। মনোসমীক্ষার প্রবর্তক সিগমণ্ড ফ্রয়েডের পরেই মনোসমীক্ষার ক্ষেত্রে এ্যাডলারের খ্যাতি। কিন্তু মনোবিশ্লেষণের প্রশ্নে দুজনার মত এক নয়। এ্যাডলারের মনোসমীক্ষাণ ব্যক্তিকেন্দ্রীক। এ্যাডলার ব্যক্তিকে একটি স্বয়ংসম্পর্ণ চরিত্র বলে মনে করেন। ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব পরিবেশ দ্বারা গঠিত। মনোবিকার বা মানসিক রোগের মূল হচ্ছে পরিবেশের সঙ্গে ব্যক্তির সংঘাত। ব্যক্তি চাই পরিবেশকে জয় করতে। জয়ের এই প্রবণতা ব্যক্তির জন্মগত। শৈশবেই এর উদ্ভব ঘটে। ব্যক্তি দৈহিক দুর্বলতা, মানসিক অক্ষমতা কিংবা অপর কোনো প্রতিকূল কারণে পরিবেশের সঙ্গে সংঘাতে জয়ী না হলে নিজের মনে সে বাস্তব অবস্থার পরিপূরক এর কপ্লজগতের সৃষ্টি করে। এভাবেই মানসিক রোগ কিংবা মসোবিকারের সূত্রপাত হয়। ব্যক্তি আপন কপ্ললোকে বাস্তব জগতের সর্বপ্রকার পরাজয়ের ক্ষতিপূরণ করার চেষ্টা করে। যে দৈহিকভাবে দুর্বল সে কল্পনা জগতে নিজেকে অপরিমিত শক্তিশালী মনে করে। এর ফলে বাস্তবের সঙ্গে ব্যক্তির সংঘাত অধিকতর বৃদ্ধি পায়। এ্যাডলারের তত্ত্ব অনুযায়ী মানসিক রোগীর রোগ দূরীকরণের জন্য ব্যক্তি শৈশবকাল এবং পরিবেশ উত্তমরূপে জানা আবশ্যক। কেন না, শৈশবকালে পরাজয়গুলিই রোগীর মনে বদ্ধমূল মনোবিকারের সৃষ্টি করে। রোগীকে এ অবস্থায় নিরাময় করবার প্রকৃষ্ট পথ হচ্ছে বাস্তবের সঙ্গে সংঘাতের বিপদ সম্পর্কে তাকে সচেতন করার চেষ্টা করা এবং যথাসম্ভব বাস্তব সঙঘাত থেকে তাকে দূরে রাখা। ফ্রয়েড যেখানে ব্যক্তির মূল জীবনবোধের পেছনে যৌন অনুভূতি এবং যৌন আকাঙ্ক্ষাকে আবিস্কার করেছেন, এ্যাডলার যেখানে ব্যক্তির জীবনবোধের পেছনে সামাজিক ক্ষেত্রে আত্মপ্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষার কথা বলেছেন। ফ্রয়েড মানসিকভাবে সুস্থ অসুস্থ উভয় ব্যক্তির মনকে যৌনাকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করেছেন। যৌনাকাঙ্ক্ষার উপর এই গুরুত্ব আরোপের ক্ষেত্রে এ্যাডলার ফ্রয়েডের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। এ্যাডলার ব্যক্তির যৌনবোধ অস্বীকার করেন না। কিন্তু তাঁর মতে যৌনবোধ বা অনুভূতি ব্যক্তির জটিল চরিত্রের মাত্র অনুভূতি। সর্বপ্রকার বোধ নিয়ে ব্যক্তির যে চরিত্র, তার বিবেচনা ব্যতীত ব্যক্তিচরিত্রের কোনো বিশেষ অনুভূতির সঠিক বিচার সম্ভব নয়। ব্যক্তির সামগ্রিক চরিত্রকে এ্যাডলার বলেছেন ব্যক্তির জীবনপ্রক্রিয়া। ব্যক্তিগত জীবনে এ্যাডলার একজন চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। ফ্রয়েডের সঙ্গে যখন তিনি যুক্ত হন, তখন ফ্রয়েড তাকেঁ মনোসমীক্ষণ সংঘের সভাপতি মনোনীত করেছিলেন। কিন্তু মনোবিশ্লেষণে মতপার্থক্যের জন্য এ্যাডলার ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রয়েডের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করে ‘মুক্তবুদ্ধি মনোসমীক্ষণবিদ সংঘের’ প্রতিষ্ঠা করেন। মতবিরোধের ফলে উভয় বিজ্ঞানীর ব্যক্তিগত সম্পর্ক তিক্তরূপ ধারণ করে। কিন্তু মনোবিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ব্যক্তি-চরিত্রের নতুনতর বিচার এ্যাডলারের খ্যাতিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব ও চরিত্রকে জানার জন্য শৈশবকে জানার আবশ্যকতা এবং দুর্বলতাবোধ থেকে যে শৈশবকালেই ব্যক্তির জীবনে পরাজয়ের গ্লানি ও বিকার দেখা দিতে পারে এবং যে বিকার বদ্ধমূল হয়ে ব্যক্তিকে মানসিক রোগীতে পরিণত করতে পারে-এ্যাডলারের এই তত্ত্ব শিক্ষা-ব্যবস্থা ও সামাজিক সমস্যা বিচারে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে গৃহীত হয়েছে। এ্যাডলারের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের ইংরেজি নাম হচ্ছে ‘দি নিউরোটিক কনসটিটিউশন’ (১৯১২) এবং ‘ইনিডিভিডুয়াল সাইকোলজি’ (১৯২৪)।
Adler, Max: ম্যাকস এ্যাডলার (১৮৭৩-১৯৩৭)
অস্ট্রিয়ার রাজনীতিক লেখক এবং দার্শনিক। অস্ট্রিয়ার সোস্যাল ডিমোক্রাটিক পার্টির তাত্ত্বিক। প্রথম মহাযুদ্ধের পরবর্তীকাল থেকে এ্যাডলার সোস্যাল ডেমোক্রাটিক পার্টির বামপন্থী গ্রুপকে সমর্থন করেন। ১৯৩০ সালে কার্লরেনার এবং রুডরফ হিলপারডিং-এর সঙ্গে যৌথভাবে এ্যাডলার ভিয়েনাতে একটি শ্রমিকদের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। অস্ট্রিয়ার মার্কসবাদে এ্যাডলারের ভূমিকার একটি দিক হচ্ছে, একটি সমাজতাত্ত্বিক তত্ত্ব হিসাবে মার্কবাদের জ্ঞানতত্ত্বকে দাঁড় করাবার চেষ্টা করেন। এ ক্ষেত্রে তিনি নব্য-কাণ্টীয় এবং আর্নেস্ট ম্যাকের পজিটিভিম দর্শন দ্বারা বিশেষ প্রভাবিত হয়েছিলেন। লেলিন পরবর্তীকালে তাঁর ‘ম্যাটেরিয়ালিজম এ্যাণ্ড এমপিরিও ক্রিটিসজিম’ গ্রন্থে ম্যাকের দর্শনকে ভাববাদী বলে সমালোচনা করেন।
Aenesidemus: এনিসিডেমাস (খ্রি. পূ. প্রথম শতক )
খ্রি. পূ. প্রথম শতকের গ্রিক দার্শনিক। জ্ঞানের ক্ষেত্রে এনিসিডেমাস সন্দেহবাদের সমর্থক ছিলেন। তিনি প্লেটোর একাডেমীর সদস্য ছিলেন। সন্দেহবাদের ক্ষেত্রে এনিসিডেমাসকে তাঁর পূর্বগামী বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক পিরহোর (৩৬৫-২৭৫ খ্রি. পূ.) অনুসারী বলা যায়। এনিসিডেমাসের মতে কোনো কিছু সম্পর্কেই সন্দেহাতীত জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব নয়। কারণ, তর্কের ক্ষেত্রে যুক্তির অভাব ঘটে না। এক যুক্তি যাকে সত্য বলে দাবি করে, অপর যুক্তি তাকে অসত্য বলে প্রমাণ করতে পারে। কাজেই সত্য ও অসত্য নিয়ে যুক্তি এবং পাল্টা যুক্তির লড়াই-এর চেয়ে শ্রেয় হচ্ছে মনের শান্তি বজায় রাখার চেষ্টা করা। যুক্তির লড়াই মনের শান্ত অভিমতকে বিনষ্ট করে। সত্যাসত্যের লড়াই ছাড়াই মানুষ জীবনযাপন করে। ‘অন্য সবাই যেমন চলে আমারও তেমনি চলাই কর্তব্য।’ সাধারণের মত গ্রহণ করা এবং অপরিহার্য বিশ্বাস করাই জীবনে শান্তিলাভের প্রকৃষ্টতম পথ। এনিসিডেমাসের পরবর্তীকালে খ্রিষ্টাব্দের দ্বিতীয় শতকে সেক্সটাস এমপিকাস-রচিত ‘দেবতায় বিশ্বাসে বিপক্ষ-যুক্তি’ নামক গ্রন্থ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। প্রাচীন সন্দেহবাদীদের মধ্যে কেবলমাত্র তাঁর রচনাই পাওয়া যায়। উপরোক্ত গ্রন্থের একস্থানে দার্শনিক সেক্সটাস এমপিরিকাস সন্দেহবাদী দর্শনকে ব্যাখ্যা করে বলেছেন, আমরা সন্দেহবাদীরা জগতের প্রচলিত কিছু অমান্য করি না। কিন্তু প্রচলিত আচার-আচরণ তত্ত্বকে আমরা বিশ্বাসও করি না। বাস্তবে যা ঘটছে সে সম্পর্কে বিশ্বাস-অবিশ্বাস, স্বীকার কিংবা অস্বীকারের প্রশ্ন অবান্তর। দেবতাদের সবাই বিশ্বাস করে; তাদের নানা উপঢৌকন দেয়। মানুষ দেবতাদের উদ্দেশে নানা আচার-আচরণ করে। সে সমস্ত আচার আমরাও পালন করি। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, আমরা দেবতার অস্তিত্বে বিশ্বাসে-কিংবা অবিশ্বাসী। জ্ঞানের ক্ষেত্রে জোর করে কিছু বলার পক্ষপাতী আমরা নই।’ (বার্ট্রাণ্ড রাসেল হিস্টরি অব ওয়েস্টার্ন ফিলোসফি-২৬২ পৃষ্ঠা)
এই ব্যাখ্যায় প্রাচীন সন্দেহবাদের একটি পরিচয় পাওয়া যায়। এনিসিডিমাসের দর্শন তৎকালীন গ্রিক সামাজিক অবস্থারও পরিচয়বাহক। গ্রিসের সমাজ-ব্যবস্থার পূর্বকার শক্তি ও সমৃদ্ধি তখন বিনষ্ট। সমাজ জীবনে অস্থিরতা প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছে। প্লেটো-এ্যারিস্টটলের দর্শন প্রতিপত্তি হারিয়েছে। এমন সামাজিক ও চিন্তাগত পরিবেশে গ্রিক সন্দেহবাদের উদ্ভব ঘটে।
জ্ঞানের বিপক্ষে এনসিডিডেমাস দশটি যুক্তি উপস্থিত করেছিলেন বলে অনেকে ধারণা। যুক্তিগুলি এরূপ: (১) মানুষের জ্ঞানের মাধ্যম হচ্ছে ইন্দ্রিয় এবং অনুভূতি। কিন্তু ইন্দ্রিয়ের বিচার এবং অনুভূতির সিদ্ধান্ত একরূপ হয় না। (২) ব্যক্তি জ্ঞান অর্জন করে। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে দৈহিক এবং মানসিক পার্থক্য বিদ্যমান। এই পার্থক্যের কারণে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির জ্ঞান পৃথক হয়। (৩) ব্যক্তির বিভিন্ন ইন্দ্রিয় একই বিষয় সম্পর্কে পরস্পর পৃথক ধারণা সৃষ্টি করে। (৪) ব্যক্তির দৈহিক এবং মনাসিক অবস্থার উপর জ্ঞানের রূপ নির্ভরশীল। দৈহিক ও মানসিক অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে জ্ঞানও পরিবর্তিত হয়। (৫) বস্তু সম্পর্কে ধারণা ব্যক্তির সঙ্গে দৃষ্ট বস্তুর দূরত্ব এবং অবস্থানের ভিত্তিতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন রূপ হয়। (৬) কোনো বস্তু বা বিষয়ের জ্ঞান কখনোই প্রত্যক্ষভাবে লাভ করা যায় না। জ্ঞান প্রতি ক্ষেত্রেই মাধ্যম-নির্ভর। (৭) বস্তুর বর্ণ, গুত, পরিমাণ, তাপ ইত্যাদি চরিত্র পরিবর্তিত হলে বস্তুর জ্ঞানও পরিবর্তিত হয়ে যায়। (৮) বিষয়ের সঙ্গে বিষয়ীর পরিচয়ের পরিমাণের ক্ষেত্রে পার্থক্য থাকলে বিষয় সম্পর্কে বিষয়ীর জ্ঞানও পৃথক রূপ লাভ করে। (৯) যাকে জ্ঞান বলা হয় তা আসলে ব্যক্তিবিশেষের অনুমান এবং অভিমত মাত্র। (১০) বিভিন্ন দেশে বিভিন্নরূপ অভিমত এবং আচার-আচরণের প্রকাশ দেখা যায়।
এই দশটি যুক্তির প্রত্যেকটি মৌলিক নয়। একটি ক্ষেত্রের যুক্তি ভিন্নতর প্রকাশে অপর ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে। কিন্তু জ্ঞানের নিশ্চয়তার বিপক্ষে এনিসিডেমাসের যুক্তিসমূহের মূল কথা হচ্ছে এই যে, সত্যের কোনো অনন্য-নির্ভর অস্তিত্ব নাই। বিভিন্ন অবস্থায় বিভিন্নরূপে একই সত্য প্রতিভাত হয়; ফলে কোনো সত্য সঠিক তা জানা সম্ভব নয়। জ্ঞানের অপরিহার্য মাধ্যম হচ্ছে ব্যক্তি। কোনো বস্তু বা বিষয় সম্পর্কে প্রত্যেক ব্যক্তির ধারণা ব্যক্তির বিশেষ অবস্থা ও পরিবেশের উপর নির্ভরশীল। ঘটনার ক্ষেত্রে কার্যকরণ সম্পর্কেও এনিসিডেমাস অস্বীকার করেন। দর্শনের ইতিহাসে আধুনিক যুগে জ্ঞানের প্রশ্নে সন্দেহবাদী দর্শনের যে প্রকাশ দেখা যায়, তার যুক্তি মূলত এনিসিডেমাস দার্শনিকের যুক্তিরই অনুরূপ।
Aesthetics: সৌন্দর্যতত্ত্ব
‘সৌন্দর্যতত্ত্ব’ কথাটি ব্যাপক। এ কারণে এর বিষয়বস্তুর সীমা নির্দিষ্ট করা কষ্টকর। সৌন্দর্যতত্ত্বের মধ্যে সৌন্দর্যানুভূতি, শিপ্লকলার বিচার, সুন্দর-অসুন্দরের পার্থক্য প্রভৃতি সমস্যাকে সাধারণত অন্তর্ভূক্ত মনে করা হয়। সৌন্দর্যতত্ত্বের সঙ্গে নীতিশাস্ত্রেরও একটি সম্পর্ক রয়েছে। এ-ক্ষেত্রে সমাজ-সংস্থার নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবর্তনে সৌন্দর্যতত্ত্বের ভূমিকা আলোচিত হয়।
সাধারণভাবে সৌন্দর্যানুভুতিকে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি আদিম অনুভূতি বলে মনে করা হয়। প্রকৃতির মোকাবেলায় আদিমকাল থেকে মানুষ বিভিন্ন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার উৎস হিসাবে কাজ করেছে। এরুপ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যে কোনো কোনোটি মানুষের মনের আবেগময় প্রতিক্রিয়া। এই আবেগময় প্রতিক্রিয়ার মূলে মানুষের জীবন রক্ষার অচেতন জৈবিক প্রয়োজনই আদিকালে সমধিক কাজ করেছে। দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে মানুষ প্রাকৃতিক ঘটনা এবং শক্তির প্রকাশকে আপন জীবন রক্ষার সহায়ক কিংবা ক্ষতিকারক বলে চিহ্নিত করেছে। এ সমস্ত শক্তিকে প্রয়োজন অনুযায়ী নিজের মনে জাগরূক রাখার সে চেষ্টা করেছে। এই আদিম বোধ থেকেই আদি শিল্পকার্যের সৃষ্টি। এই উৎস থেকে সামাজিক ভালোমন্দ বোধেরও উৎপত্তি।
মানুষের নিজের জীবনের মতোই সৌন্দর্যানুভূতির ইতিহাস দীর্ঘ। সভ্যতার জটিল বিকাশের ধারায় সৌন্দর্যতত্ত্বকেও প্রাথমিক যুগে সহজ এবং আধুনিককালে জটিল এবং অবাস্তবের লক্ষণযুক্ত দেখা যায়।
কোনো বস্তু বা ঘটনা সম্পর্কে ব্যক্তির মনের আবেগময় অনুভূতি এবং তার ভাষাগত প্রকাশ ব্যতীত শিল্পকলা, ভাস্কর্য, সঙ্গীত এবং অন্যান্য মানবিক সৃষ্টিকে সুন্দর কিংবা অসুন্দর এবং ভালো কিংবা মন্দ হিসাবে বিচারের প্রয়াসকে সৌন্দর্যতত্ত্ব বলে অভিহিত করা হয়। সৌন্দর্যতত্ত্ব বলতে উপরোক্ত বিষয়গুলি সম্পর্কে বিশেষ কোনো তত্ত্বকে বুঝায় না। এর দ্বারা উপরোক্ত বিষয়গুলির উপরে বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন চিন্তাবিদের চিন্তা কিংবা ভাবধারার কথা বুঝায়। সৌন্দর্যতত্ত্বের সামগ্রকি আলোচনায় সুন্দর এবং অসুন্দরের অথবা ভালৌ এবং মন্দের কোনো নির্দিষ্ট আদর্শ কিংবা মানদণ্ড আছে কিনা সে প্রশ্ন নিয়েও আলোচনা করা হয়।
সৌন্দর্য়তত্ত্বের উদ্ভব প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে ব্যাবিলন, মিসর, ভারতবর্ষ এবং চীনের দাস-প্রধান সমাজে লক্ষ্য করা যায়। পরবর্তীকালে গ্রিসের হেরাক্লিটাস, সক্রেটিস, প্লেটো, এ্যারিসস্টটল এবং অপরাপর দার্শনিকের রচনায় সৌন্দর্যতত্ত্বের জটিলতর বিকাশের আমরা সাক্ষাৎ পাই। প্রাচীন রোমের দার্শনিক লুক্রেশিয়াস এবং হোরেসও সৌন্দর্যতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেন। মধ্যযুগে সেণ্ট অগাস্টিন এবং টমাস একুইনাস প্রমুখ ধর্মতাত্ত্বিকগণ সৌন্দর্যতত্ত্বে রহস্যবাদের আমদানি করেন। তাঁদের মতে, জগতাতীত এক ঐশ্বরিক সুন্দরের অস্তিত্ব রয়েছে। সেই ঐশ্বরিক সুন্দরের মানদণ্ডেই জাগতিক বস্তুনিচয়ের সৌন্দর্য পরিমাপ করতে হবে। মধ্যযুগের এই রহস্যবাদের প্রতিক্রিয়া ঘটে পরবর্তীকালে নব-জাগরণের চিন্তাবিদ এবং দার্শনিকগণের মধ্যে। এঁদের মধ্যে পেতরার্ক, আলবার্ট, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, দুরার,ব্রুনো এবং মণ্টেনের নাম বিখ্যাত। পাশ্চাত্যের নব-জাগরণের পরবর্তী জ্ঞানাস্বেষণের যুগের চিন্তাবিদদের মধ্যে বার্ক, হোগার্ত, ডিডেরক, রুশো, লেসিং প্রমুখ খ্যাতি অর্জন করেন। মানবতাবাদের এই ঐতিহ্যকে বহন করে সাহিত্যের ক্ষেত্রে শিলার এবং গ্যেটে ঘোষণা করেন যে, সৌন্দর্য এবং শিল্পের উৎস হলো মানুষ এবং তার বাস্ত জীবন।
সৌন্দর্যতত্ত্বের ইতিহাসে দুটি প্রধান ধারার সাক্ষাৎ সব যুগেই পাওয়া যায়। এদের একটি হচ্ছে সৌন্দর্য সম্পর্কে বস্তুবাদী ধারণা; অপরটি ভাববাদী। ভাববাদী সৌন্দর্যতত্ত্ব সৌন্দর্যকে অতি-প্রাকৃতিক একটি সত্তা বলে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে। অতি-প্রাকৃতিক এই সত্তা সাধারণ মানুষের বুদ্ধি এবং সিদ্ধির অতীত। সমাজের উচ্চতর শ্রেণীর মানুষের পক্ষেই মাত্র এই নিকষ সুন্দরকে উপলব্ধি করা সম্ভব। এরূপ ব্যাখ্যায় ভাববাদী সৌন্দর্যতত্ত্ব এবং সুন্দরের ধর্মীয় রহস্যবাদী কল্পনায় কোনো পার্থক্য নেই। সাধারণ মানুষকে অজ্ঞানতার মোহ আবদ্ধ রাখার প্রয়াস সমাজের শক্তিমান শ্রেণীগুলো সব যুগেই করে এসেছে। সৌন্দর্যতত্ত্বের ক্ষেত্রে দর্শনের অন্যান্য মৌলিক প্রশ্নের ন্যায় ভাববাদের বিরোধী ব্যাখ্যা হচ্ছে বস্তুবাদী ব্যাখ্যা। বস্তুবাদী দার্শনিকগণ মানুষের বাস্তব পরিবেশ এবং জীবনের মধ্যেই সৌন্দর্যানুভূতির সৃষ্টি এবং বিকাশকে লক্ষ্য করেছেন। সৌন্দর্যতত্ত্বে বস্তুবাদ এবং ভাববাদের বিরোধ সমাজের শোষক এবং শোষিতের বাস্তব বিরোধের ভাবগত প্রতিফলন।
বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সৌন্দর্যতত্ত্বে তিনটি প্রশ্ন মূল (১) বস্তুজগতে সৌন্দর্যের সৃষ্টি এবং বিকাশ; (২) মনোজগতে সৌন্দর্যানুভূতির ব্যাখ্যা, এবং (৩) শিল্পকর্মের মূল্যায়ন। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মতে পরিবেশের সঙ্গে মানুষের প্রবহমান ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্পর্কের ধারাতে ক্রমাধিক পরিমাণে আনন্দজনক জীবনযাপনের তাগিদে সুন্দর, অসুন্দর, মহৎ, হীন, হর্ষ এবং বিষাদ প্রভৃতি অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছে।
ব্যাপকতার দিক থেকে সৌন্দর্যতত্ত্ব কেবল শিল্পকলার সৌন্দর্যকে বিশ্লেষণ করে না। শিল্পকলার সৌন্দর্যের বিশ্লেষণে সৌন্দর্যতত্ত্বের একটি প্রয়োগগত দিক মাত্র। ব্যাপকভাবে সৌন্দর্যতত্ত্বের আলোচ্য হচ্ছে মানুষ। তার সৃজনশীল ক্ষমতার বাস্তব প্রকাশে, মহতের জন্য জীবন উৎসর্গে, দাসত্ব থেকে মুক্তির সংগ্রামে যে আনন্দানুভূতি সে বোধ করে কিংবা বর্বরতার আঘাতে যে ঘৃণা তার মনে উদ্ভূত হয়, তার বিকাশ-প্রক্রিয়া এবং বৈশিষ্ট্য।
Agent Provocateur: প্ররোচক, উস্কানিদাতা, দালাল
রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষ অনেক সময়ে নিজ পক্ষীয় লোককে অন্য পক্ষের ভিতর প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষের সমর্থকের ছদ্মবেশে অনুপ্রবেশ করিয়ে দেয়। এরূপ কৌশলের প্রধান উদ্দেশ্য হয় ছদ্মবেশী সমর্থক দ্বারা এমন কোনো ঘটনার সৃষ্টি করা যার ফলে উক্ত পক্ষের কোনো মারাত্মক ক্ষতি সাধিত হতে পারে। ক্ষতিগ্রস্থ পক্ষ এরূপ লোকের সন্ধান পলে তাকে প্ররোচক, উস্কানিদাতা বা দালাল বলে অভিহিত করে। ইংরেজি ‘এজেণ্ট প্রভোকেচার’ কথাটির মূল ফরাসি। এর অর্থ উস্কানিদাতা বা প্ররোচক। অনেক সময়ে দেখা যায় যে, কোনো রাজনীতিক দল নিজের ব্যর্থতার দ্বায়িত্ব কল্পিত ‘প্ররোচকের’ ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। শূধু প্রতিদ্বন্দ্বী দল নয়, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এক রাষ্ট্র কর্তৃক আর এক রাষ্ট্রকে আক্রমণের অজুহাতে সৃষ্টির জন্য প্ররোচক দ্বারা মারাত্মক ঘটনা ঘটাবার বহু দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।
Agnosticism : অজ্ঞেয়বাদ
সাধারণভাবে অজ্ঞেয়বাদ বলতে জ্ঞানের ক্ষেত্রে জগৎ বা বিশ্বকে জানার অক্ষমতা বুঝায়। এদিক থেকে সন্দেহবাদ বা সংশয়বাদের সঙ্গে অজ্ঞেয়বাদের সাদৃশ্য আছে। কিন্তু অজ্ঞেয়বাদ কথাটি সংশয়বাদের মত প্রাচীন নয়। অজ্ঞেয়বাদের ইংরেজি শব্দ এ্যাগনসটিসিজম-এর প্রথম ব্যবহার দেখা যায় ঊনবিংশ শতকে ইংরেজ বৈজ্ঞানিক টমাস হাক্সলীর রচনায়। ধর্মের ক্ষেত্রে বিধাতার অস্তিত্তকে জানা সম্ভব কি অসম্ভবের প্রশ্নে অজ্ঞেয়বাদের উদ্ভব। উনিশ শতকে ধর্মের বিতকেৃ এরূপ একটা অভিমতের প্রকাশ দেখা যায় যে, জ্ঞানের ব্যাপারে মানুষের যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে তাতে বিশ্বরাচরের কোনো বিধাতা আছে কিংবা নাই এরূপ কোনো সিদ্ধান্তে পৌছানই মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। সেরূপ কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের অর্থ হচ্ছে মানুষ যে সীমাকে অতিক্রম করতে পারে না, সেই সীমাকে অতিক্রম করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দাবি করা।
অজ্ঞেয়বাদের এই যুক্তি প্রধানত অষ্টাদশ শতকের কাণ্টীয় দর্শনের উপর ভিত্তি করেই করা হয়। আধুনিক ইউরোপীয় দর্শনে জ্ঞানের প্রশ্নে সন্দেহবাদের শুরু হয় ইংরেজি দার্শনিক হিউমের মধ্যে। হিউম জ্ঞান সম্পর্কে ১৭৪৮ খ্রিষ্টাব্দে ‘এ্যান এনকোয়ারি কনসারনিং হিউম্যান আনডারস্ট্যাণ্ডিং’ নামে একখানি পুস্তক রচনা করেন। তাঁর এই গ্রন্থে প্রধানত তাঁর পূর্বগামী ভাববাদী ধারণার জবাব হলেও তাঁর যুক্তির মারফত, মানুষের আদৌ কোনো জ্ঞান সম্ভব কিনা, সে মৌলিক প্রশ্নও উত্থাপিত হয়। পরবর্তীকালে জার্মান দার্শনিক কাণ্ট জ্ঞানের ক্ষেত্রে ভাববাদকে হিউমের মৌলিক আঘাত থেকে রক্ষা করাই জন্যই তার ‘নু মেনা’ বা মূল সত্তা হিসাবে বস্তুকে জানার অসম্ভবতার তত্ত্ব উপস্থিত করেন। তাঁর মতে মূল সত্তা হিসাবে বস্তুর অস্তিত্ব অবশ্যই আছে। কিন্তু মানুষ নিজের জ্ঞানসূত্র বা কাণ্টেগরি ব্যতিত কোনো কিছুর জ্ঞানই লাভ করতে পারে না। কিন্তু জ্ঞানসূত্র মারফত দৈনন্দিন-দৃষ্ট বস্তুকেই মাত্র জানা যায়। অ-দৃষ্ট মূল বস্তুসত্তাকে জানা যায় না। আধুনিক অজ্ঞেয়বাদ ধর্মের ক্ষেত্রে কাণ্টের যুক্তি প্রয়োগ করে বিধাতাকে স্বীকার-অস্বীকারের বাইরে রেখে দেবার প্রয়াস পায়। ঊনবিংশ শতকে দর্শনের ক্ষেত্রে অজ্ঞেয়বাদের উদ্ভব বৃহত্তর বাস্তব জীবনে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি এবং আর্থিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে-পুঁজিবাদ-বিরোধ শ্রমিক শ্রেণীর অগ্রগতি এবং আর্থিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে পুঁজিবাদ-বিরোধী শ্রমিক শ্রেণীর ক্রমবর্ধমান শক্তি এবং সামাজিক সমস্যার সঙ্গে জড়িত। বিজ্ঞানের অগ্রগতি বাস্তব জগতের উপর মানুষের সমস্যার সঙ্গে জড়িত। বিজ্ঞানের অগ্রগতি বাস্তব জগতের উপর মানুষের শক্তিকে যত বেশি প্রতিষ্ঠিত করে তুলছিল, তত বেশি ধর্ম এবং দর্শনের রাজ্যে ভাববাদের নতুনতর যুক্তি আবশ্যক হয়ে উঠেছিল। এমন পরিস্থতিতে কাণ্ট যেমন দর্শনের ক্ষেত্রে জটিল যুক্তিজালে ভাববাদকে রক্ষা করার প্রয়াস পেয়েছেন, তেমনি ধর্মের ক্ষেত্রে অজ্ঞেয়বাদ বিধাতার অস্তিত্বকে জ্ঞানের বাইরে রেখে তাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে। আধুনিক অজ্ঞেয়বাদ পরিণামে কেবল ধর্মের ক্ষেত্রেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখে নি। অজ্ঞেয়বাদীদের মতে কেবল যে, বিশ্ব-বিধাতাই অজ্ঞেয়, তাই নয়। মানুষের কাছে প্রাকৃতিক বিধান, সমাজের বিকাশের ধারা-সবই অজ্ঞেয়। তাই তাঁদের মতে বিজ্ঞান যে বিশ্বজগতের কোনো নির্দিষ্ট জ্ঞান আমাদের দিতে পারে, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ অজ্ঞেয়বাদকে অসার বলে অভিহিত করে। আধুনিক দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের প্রবক্তাদের অন্যত্তম হচ্ছেন ফ্রেডারিক এঙ্গেলস তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ ‘এ্যাণ্টিডুরিং’-এ অজ্ঞেয়তাবাদকে খণ্ডন করেছেন। তাঁর মতে বস্তুকে মানুষ আদৌ জানতে পারে কিনা, এ প্রশ্ন নিয়ে মানুষের মাথা ঘামাবার দিন শেষ হয়ে গেছে। কারণ মানুষ বস্তুকে কেবল তাত্ত্বিকভাবেই জানছে না। বাস্তবভাবে সে বস্তুকে স্পর্শ করছে, বিশ্লেষণ করছে, তার অন্তর্নিহিত বিধি-বিধানকে জানছে এবং জ্ঞাত সেই বিধানকে প্রয়োগ করে বস্তুকে সে নতুনভাবে গঠনও করছে। এর পরে জ্ঞানের ক্ষেত্রে অজ্ঞেয়বাদের অবকাশ থাকে না বলে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ অভিমত পোষণ করে।