সাতমাথা সিরিজ
একটা আঙুল তোমাকে প্রতিদিন লেখে। আঙুল ভেদ করে মন জেগে ওঠে। মনের শাখা প্রশাখা জুড়ে থাকে বুকের ঘাম, চোখের কর্ণিয়া; ঠোঁটের পেলব স্পর্শ; পায়ের ছুটে চলা; ভাব; আমি ভার্চুয়াল জগৎ ঘুরে-ঘুরে বেড়াই কেবল আঙুল নিয়ে। আঙুল নয়; মন ঘুরে বেড়ায় আত্মার সঙ্গী হয়ে। সাতমাথায় লক্ষ কোটি চোখ; চোখগুলো দেখে যুবতী নারীকে শরীরের ভাঁজে-ভাঁজে দেখে তেঁতুলের ঝাল আচার; মরিচ; রসুন; আর জলপাইয়ের টক। মুখের ভিতর ঝর্ণার ধারা; চোখে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ; পায়ের পাতা সাতমাথার আঙ্গিনায় চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। মন খোঁজে রসগোল্লা। ‘তুমি মিষ্টির মত’- বলতেই বললে; ‘আনো তবে কাঁটাচামচ; কাঁটাচামচে ফালি-ফালি করো দেহের বৃক্ষ।’
তোমার শরীরের টুকরাগুলো সাতমাথা বীরশ্রেষ্ঠ স্কয়ারে গিয়ে শহীদদের ছবির ভিতর ঢুকে পড়ে। চেতনার ভাস্কর্য হয়ে মিশে থাকে আমাদের বুকের জমিনে। চরের বুকে বন্যা, রহিমুদ্দীন দাওয়ায় বসে হুকা টানে; পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে জমিলা বিবি চেয়ে থাকে। যমুনা নদীর দিকে। নদীর পানির উপর ভেসে ওঠে সাদা থান। নোলক পরা কহিনুর বিবি নদীতে নিজের মুখ দেখে। মুখ হঠাৎ ভাতের সানকী হয়; কচুপাতা ভর্তা; তিষিভর্তা; তিল ভর্তা আর মসুরের পাতলা ডাল সানকিতে সাজানো। নোলক খসে পড়ে; জল নড়ে; শুধু ভাতের সানকি ক্ষুধার মানচিত্র হয়ে ঝুলে থাকে নোলকের সামনে। ঝন্টু মিয়া খড়ের ঘরে বসে আছে; পাশেই নিভুনিভু করে জ্বলে ল্যাম্প; সলতে পুড়ে যাচ্ছে ধীরে-ধীরে। কেরোসিন তেল পড়ে থাকে। সারিয়াকান্দির স্টোররুমে। দুলুমামা; ধান ডুবে যাওয়ার গল্প করতে-করতে ডুকরে কেঁদে ফেলে। হাঁস, মুরগী, ভেড়া, গরু-ছাগলের সুন্দর চোখগুলোতে বন্যার পানির তরতর করে বেড়ে ওঠে। কচুর লতি চিংড়ি মাছের তরকারীর ঘ্রাণে মায়ের চোখে পাকা ধানের বাতাস।
সাতমাথার কোলাহলে এসব এখন ছোট ছোট গল্প হয়ে ওঠে। হঠাই আমি চুপ হয়ে যাই; আস্ত এক বোবা মানুষ হয়ে যাই; মূর্তির মত ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকি। তুমি উপেক্ষা মনে করে হনহন করে দৌঁড়ে পালাও নদী-বাংলায়; পড়ুয়ায়। পার্টি অফিসের ঝালমুড়ির আলাপে মেতে ওঠো সহসা।
দুই.
সাতমাথায় কয়েকটি চায়ের স্টল।
নিকুঞ্জ দাদার চায়ের স্টলে জমা হয় আদা; মাল্টা; মরিচ; আর
দারুচিনি, এলাচ; কেটলিতে পানি সিদ্ধ হতে থাকে।
সিদ্ধ পানির ভিতর একটা পরিবার তার সুখের রুমাল ভাসতে দেখে।
নিকুঞ্জে মানুষ আসে।
চায়ের কাপে চুমুক দেয়।
আদা চা আর মাল্টা চা;
মরিচ চায়ে চুমুক দিয়ে ঠোঁটে লেগে থাকে একবাটি সুখ।
সুখের ধারায় ভেসে ওঠে কিছু মানুষের মলিন মুখ।
সাতমাথার সবুজ শাড়ি দিন শেষে
রাতের কার্ণিশে ঝুলে থাকে পতাকা হয়ে।
ভাস্কর্য ভাঙ্গা অন্ধকার সাতমাথাকে গিলে ফেলে রাতের দ্বিপ্রহরে ।
সাতমাথা জেগে থাকে;
সাতমাথা ঝুলে থাকে।
শুধু ভাস্কর্য ভেঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা পাতা মানুষগুলো
সাতমাথার চারপাশে ঘুরে বেড়ায় রাতের শেষ প্রহরে।।
তিন.
সুতোর সমুদ্র পেরিয়ে গোলাপি অনুভূতিগুলো আঙুর হয়।
মা কালির রক্তমাখা জিহ্বা ক্লিওপেট্রার ফিনফিনে বসন হয়ে ওড়ে।
সাতমাথার দরজা জানালা খোলা থাকে।
শোকের মিছিল অট্টহাসি হয়ে ঢুকে পড়ে ইতিহাসে।
উচ্চতা মাপতে-মাপতে ক্লান্ত হয় রোদের ঢেউ।
অতঃপর পূর্ণিমা রাতে বৃত্ত ভেঙ্গে বেড়িয়ে আসে
সাতমাথায় উড়ে বেড়ানো
হাজার-হাজার; লক্ষ-লক্ষ কোটি-কোটি বছর আগে
মৃত বাদুর শরীর।
সাতমাথা ঘুমিয়ে যায় মেঘবৃষ্টির বিলাপ নিয়ে।
যাযাবর উড়ে যায় কার্বন পাহাড়ের চূড়ায়।
যেখানে বোবা পাখিও কথার চাষ করে সবুজের মানচিত্রে।
ঘুমঘুম চোখে বীরাঙ্গনা হাঁটে বাদুরের কোলাহলে।।
অনাগত সময় জলপাই রঙের শাড়ি হয়ে বীরাঙ্গনার শরীর
ইশকাপনের বিবির মত গর্ভবতী শব্দ হয় শেষরাতে।
মাছের মত অসংখ্য সন্তান মহাকালের সীমানায় পড়ে থাকে।
সাতমাথায় একটি বীরাঙ্গনা আর এক মানব শিশু
হাঁটে অবিরাম বাদুর প্রাণ নিয়ে।
চার.
কবি সহসা ফেরে সাতমাথার গোল চত্বরে।
ফেলুদার চরিত্র নিয়ে ডিটেকটিভ জাকারিয়া
সাতমাথার ডিমের ভিতর মোরগ আর মুরগী দেখে।
বলাকা মন নিয়ে লটোর সামনে দাঁড়িয়ে থাকে ডাকবালিকা
লাল জামা আর কালো শাড়ির গল্পগুলো
সাতমাথার ধূলিতে লুটোপুটি খায় ।
রাতের সাতমাথা মস্তবড় বেলুন হয়।
বেলুনে জমা হয় শত-শত হাজার-হাজার ঘন নিঃশ্বাস ।
নিঃশ্বাসগুলো গুনতে-গুনতে রাত শেষ হয়…
তবুও গণনা নির্ভুল হয়না।
আবার একটি রাত আসে,
সাতমাথার বুকের জমিনে গল্প জমা হয়;
জমা হয় আঙুলের চিহ্ন।
আঙুলগুলো মানুষের মুখের উপরে পড়ে থাকে আরেকটি গল্প নিয়ে।
সাতমাথার কোলাহলে পড়ে থাকে নিঃশ্বাস;
পড়ে থাকে গল্প; পড়ে থাকে জীবন।
সাতমাথা পায়ে-পায়ে হাঁটে।
যে রাস্তার সীমা নেই; শেষ নেই; ক্ষয় নেই।
সাতমাথার গল্পে ভাসে একটি বলাকা-মন পাখি।
তারই পাশে শুয়ে থাকে কবি ও কবিতা।
পাঁচ
শরীরের ভিতর শরীর; মনের ভিতর মন;
চোখের ভিতর মস্ত আকাশ।
তরুণী শিশুর মিষ্টি হাসির ভিতর ফুল দেখে;
নদী দেখে; পাখি দেখে; ঝর্ণা দেখে।
রাতজাগা যুবতী পাখিটি বইয়ের ভাঁজে-ভাঁজে নতুন মহাকাল দেখে।
শিশুটির পিতা সাতমাথা থেকে পালিয়ে নাগর নদীর জলে
পা ডুবিয়ে দেবজ্যোতির স্বপ্নে বিভোর থাকে ।
নদীর রূপালি মাছের শরীরে যুবকের ঘন নিঃশ্বাস জমে থাকে।
সত্যগুলো মিথ্যে প্রসূণ প্রেমকে ধারণ করে সাতমাথার জলে ভাসে।
যুবকের চারপাশে ঘেরা অরণ্য;
চারপাশে থাকে কিছু নগ্ন ধারালো হাত।
যুবক উল্লাসে ঘুরে বেড়ায় সাতমাথায়;
জাসদ অফিসের সামনের চায়ের স্টলে;
নিকুঞ্জের চায়ে চুমুক দিয়ে যুবক
নিজের শুক্রানুকে ছুঁড়ে দেয় মাতৃগর্ভে।
মাতৃগর্ভে মহাকাল পড়ে থাকে।
মাতৃগর্ভে যুবকের নাভি ওঠা নামা করে।
যুবক পাপ না; যুবক শুদ্ধ।
সব পাপ জমা হয় নগ্ন নারীর স্তনে; পেটে;
আর সাতমাথার বুকের ঘরে।
শালিক জীবন নতুন পথের পথিক হয়ে
আরেকটা চরের স্বপ্ন দেখে।
ছয়.
মানুষগুলো এক একটি শাখা-প্রশাখা হয়ে মেলতে থাকে;
অবশেষে তরুণ ফিরে আসে সাতমাথায়;
খোকন পার্কের গেট পেরিয়ে,
উদীচী পেরিয়ে পার্টি অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে।
বুক ভরে সাতমাথার শ্বাস নেয়,
নিকুঞ্জের চায়ে চুমুক দিতে-দিতে মানুষটি
ঘুরে বেড়ায় আফ্রিকার ঘন জঙ্গলে;
জাফলংয়ে; দার্জেলিংয়ে।
আমি সাতমাথায় দাঁড়িয়ে মানুষটির বৃক্ষ শরীরের
সবুজ হই; পাতা হই;
ডাল পালা আর শাখা-প্রশাখা হই।
মানুষটি সাতমাথার চায়ের পেয়ালায় একটি মুখ দেখে।
সে মুখ মহাকালের বিছানায় চিৎ হয়ে পড়ে থাকে।
মানুষটি সাতমাথার কোলাহলে কেবল একটি বৃক্ষ দেখে।
আর দেখে শালিক-শালিক জীবন।
তবুও সাতমাথা মহাকালের কোলে পড়ে থাকে
সবুজ বৃক্ষ হয়ে মানুষটির বুকের পাটাতনে।
সাত.
সাতমাথার মাটির ব্যাকরণে সভ্যতার বিনির্মাণ হয়
সময়ের মহাকাব্য ভাষার।
প্রতিবাদের খড়কুটো চোখের মাঠে।
মানবিক উচ্চারণে পথের চিহ্ন প্রান্তরে;
প্রচ্ছদে ফুটে ওঠে পথ-শিশুদের সবুজ পতাকা-মন।
বিপন্ন মাটির চোয়ালে কৃষকের নিশ্চল পা।
ফসলের ভাঁজে জমে থাকা শ্রমের শিশির
সবুজ চিত্রকলায় ক্ষুধার্ত মানুষের আত্মার ঘ্রাণ হয়।
বুকে নরম ধানকাব্য।
ধান ডুবে যায়; ডুবে যায় সময়ের চিত্র।
শুধু খরার অপেক্ষা বিপন্ন মাটির।
মুঠোবন্দি কূটকৌশলগুলো বুকপকেটে জমা হয় বৃষ্টির অভিধান হয়ে ।
চেতনার পেয়ালায় ক্ষুধার অশ্রুগুলো ভাতের কাব্য হয়।
সাতমাথার সাঁকো বেয়ে পৃথিবীর সেভেন সামিট ঘুরে আসে টোকাইরা ।
মাটির প্রহসন নিয়ে রহিমুন নেছা ভিক্ষার ঝুলির টাকা গোনে মাঝরাতে ।
উদাসীন মেঘ চায়ের পেয়ালায় গোপন গল্পের উঠোন দেখে ।
জীবনের অভিধান খুলে ভ্রাম্যমান কষ্টগুলো
সাতমাথার পার্টি অফিসের সামনে দাঁড়ানো,
নাগরিক বৃক্ষে পাতা হয়ে ঝুলে থাকে।
আট.
পৃথিবীর আয়তন বাড়ে বাতাস ও জলের মত।
মায়ের স্পর্শ হলুদ শর্ষেক্ষেতে নরম বিকেল।।
শৈশবে ধু-ধু বালুচর জুড়ে পড়ে থাকে
লোটাগাড়ি;
সোনাইতলী;
কাজলাপাড়; কদমতলীর ভিটেমাটি।
সঙ্গমের ত্রিভূজ বিছানায় শুয়ে মা কার্তিকের নবান্ন দেখে।
পৌষের মিঠে রোদে বসে ডালের বড়া বানায়।
কচুর ডাল দিয়ে সিদোল ভর্তার বড়া বানায়।
মেঘের স্তম্ভ ভেঙ্গে বাবার সদর দপ্তরে।
মাথার লম্বা চুল পিঠের উপর ছড়িয়ে থাকে সুদীর্ঘ পথ হয়ে!
বাবার বুকের বারান্দায় সােয়েটার আর চাদর সারি-সারি ঝুলে থাকে।
মা হেঁসেলের কাছে বসে
দুধপিঠা;
ভাপা পিঠা;
নারকেলের বরফি
কুলি পিঠা বানায়।
টিমটিমে আলো জ্বলে খোলা আঙ্গিনায়।
রাত্রির গায়ে পিঠার মানচিত্র।
কালো চুলের নিচে জ্বলন্তচুল্লী।
সাদাচুলে কুয়াশা।
জীবনের বায়ােস্কোপে সহসা সাতমাথা জেগে ওঠে।
সাতমাথার সানকিতে
সাদাপানিভাত;
পেঁয়াজ;
কাঁচামরিচ পাড়ো মরিচের গন্ধ বাতাসে।
মেঘের ভিতর শাড়ির নৃত্য।
সাতমাথায় মা হাঁটে ধূর্ত মহাকাল বুকে নিয়ে।
নয়.
সাতমাথা তারার ফুল হয়।
অসংখ্য নতুন মুখে ভরে যায় সাতমাথার মাটি।
সাদা চাদর বিছিয়ে কবুতর; শালিক ঘুমায়।
কথা হয় মনে-মনে।
অদৃশ্য কথাগুলো পাসওয়ার্ড খুলে ঢুকে পড়ে মনের উপত্যকায়।
যুবক-যুবতীর হৃৎপিণ্ডে হাজার হাজার কবিতা।
কবিতাগুলো সভ্যতার প্রেসে ছাপা হতে থাকে।
সুদীর্ঘ মহাকাল ভ্রুণের সজীবতা নিয়ে
বৃন্দাবন ছেড়ে সাতমাথার উঠোনে এসে
আকাশের বুক খুলে নক্ষত্র শরীর ঘেঁটে দেখে
যুবতী জ্যোৎস্না জলরাতে একজোড়া চড়ইয়ের ভেসে থাকা।
মৃত্যুকে নিশ্চিত জেনেও উঠে এসেছিলে আঙুলের মােহনায়।
জীবনের রঙ মহাকালের উপর দিয়ে ভ্রমণ করে।
নক্ষত্র জন্মের জ্যামিতিক ইতিহাস হয়ে
সাতমাথা ঘুমিয়ে থাকে পৃথিবীর শস্যখেতে।
যেখানে আত্মার রোদে চাষ হয় নক্ষত্র জন্মের ভিতর
বেড়ে উঠা সাতমাথার জন্মকথা।
দশ.
ঘুমগুলো চোখে নয় হৃদয়ে আসছে।
হৃদয় ঘুমাক আজ…,
সাতমাথা বুকে নিয়ে…,
বাবার স্মৃতি বালিশের মধ্যে বন্দি হাঁকে রাতের চাদরে।
বাবার লম্বা হাত দুটো ধরে হেঁটে যেতাম ললাটা গাড়িতে।
হাত ভরে তুলে আনতাম শাপলা।
বাবার মুখে তখন ফুটে উঠতো আলো।
কুয়াশা ভেজা ঘাসের উপর নরম পা ফেলে হাঁটতে-হাঁটতে আমি শিশু শিক্ষার পাঠ নিতাম। আর এখন…!
সাতমাথার সামনে বাবা হাঁটে চেতনার সাদা কাফন হয়ে।
বাবা এখন বাতাস হয়ে ওড়ে,
সাতমাথার অক্সিজেন আর কার্বন ডাই অক্সাইডে…