কাটাকুটির চিরকুট
চাকরির বিজ্ঞাপন কাটছি –
আপনিও লিস্টে আছেন, শীঘ্রই আপনার সব অপমান কাটবো।
সে মাছ কাটে, সে চুল, আর ওই মিনমিনে লোকটা কাটে মানুষের গলা। উনি কোট পড়ে শ্রমিকের বেতন কাটেন, উনি বাজেট, আর তিনি কাটেন সংসারে সুখ। আমার এতো ক্ষমতা নেই, তবু আমিও কাটি।
অনেক দিন ধরেই কাটছি – পত্রিকার বিজ্ঞাপন। আপনি হাসছেন? হাসুন –
আজ চাকরির বিজ্ঞাপন কাটছি –
আপনিও লিস্টে আছেন, শীঘ্রই আপনার সব অপমান কাটবো।
চাকরির খবরটা এলেই ফেইসবুকে এক ধারালো স্ট্যাটাসে কেটে ফেলবো সব অবহেলা-করুণা-বিদ্রুপ। আত্মীয়-বন্ধুর তালিকা থেকে কাটবো অনেক নাম। ‘বেকার ছেলের জননী’- তালিকা থেকে মায়ের নাম কাটবো। পারলে মায়ের জন্য হজে যাবার টিকিটও কাটবো। বোনের পরীক্ষার ফি’র রিসিপ্ট নিজের হাতে কাটবো।
অবশ্য কিছু জিনিস আর কাটতে হয় না –
বাবার কাছে টাকা চেয়ে টেলিফোনটা অনেকক্ষণ বাজতে বাজতে এমনিতেই কেটে যায় – বাবাকে আর লাইন কাটতে হয় না। তিনি চলে গেছেন – আমার অপেক্ষার ছোট্ট আকাশটা কেটে অনেক বড়ো আকাশে। চাকরি পেলে – আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাটির নাম কেটে লিখে দেবো – ‘বাবা’।
ও, ভুলে গিয়েছিলাম –
বেলা বোসের নাম অটোমেটিক কেটে গেছে – সে এখন নাইটি পড়া কাজল বধূ, পাশের এক পাড়ায়। আপনি এবারও হাসছেন? হাসুন –
এখনো চাকরির বিজ্ঞাপন কাটছি –
আপনিও লিস্টে আছেন, শীঘ্রই আপনার সব অপমান কাটবো।
আপনার সব ধার শোধ করে আপনাকে মুক্তি দেবো আমার সকল কাটাকুটি থেকে।
মেঘের চিরকুট
পড়ছি কেন? চাকরি চাই – রিসার্চ ফিসার্চ বুঝি না
সাগর এলে পায়ের কাছে, নামবো সবাই লবণ চাষে
মুক্তা-টুক্তা খুঁজি না
দুই
মানবতার রঙও দেয়াল খোঁজে
কোনখানে বেশি আলো – বোঝে
সব আর্তনাদ সবাইকে ছোঁয় না
অনেক কাঠই কয়লায় থেমে যায়
হীরা আর হয় না
তিন
সুখগুলো সব পাহাড় হবে – দুঃখগুলো পাখি
একদিন ঠিক বদলে দেবো, সেই আশাতেই থাকিতিন
চার
রাতের কষ্ট পুড়িয়ে পুড়িয়ে জ্বলে সব তারা
সফলতার গল্প হয় না – বিফল মানুষ ছাড়া
পাঁচ
একলা তুমি? কেউ পাশে নেই? আজো তোমার কান্না থামেনি?
কেবল তাকিও না, দেখো –
শুধু তোমায় নিয়ে ওড়বো বলে – আজো আমি ওড়া শিখি নি
চুপকথা
ছুটিতে ছিলো চাঁদ –
কৃষ্ণা পঞ্চমী, অন্ধ একটি রাত
অন্ধ দাদু বলছিল রূপকথা
ছোট চাচার লোমশ দুটি হাত
আমার বুকে লিখছিলো – অশ্লীল চুপকথা
কাঁদছিলো শুকতারা – কাঁদেনি আমার ব্যথা
তবু সেই থেকে ব্যথার মনে চিনচিন নীরবতা
দাদুর গল্পে ব্যাঙ্গমী ফিসফিস – রাজকন্যার দু:খের কথা
আমি রাজকন্যা নই – আমাকে শোনার সময় কোথা?
অন্ধ-গল্প চলেছে টিকটিক – ব্যাঙ্গমী কাউকে বলেনি
ময়ূর-পঙ্খী উড়েছে দশদিক – রাজকুমার আসেনি
ঘুমাচ্ছিলাম আধোভয়ে। শিথানে সোনার কাঠি, পৈথানে রূপার
রাজ-কুমার আসি আসি করে, শেষ হয়নি রূপকথা আমার
দিন যায় হেঁটে হেঁটে, রূপকথার গন্ধ নিয়ে
একদিন বৃষ্টি এলো, রবিঠাকুরকে মাথায় দিয়ে
ভেজাতে চাইলো স্বপ্ন আমার, মিচকা বুড়া মাস্টার
কাদম্বরী দেবীর আড়ালে গিয়ে
সেদিনও ছুটিতে ছিলো চাঁদ, শুকতারা জ্বলেনি
আমার বৃষ্টির গল্প শেষ হতে হতেও, শেষ হয় নি
দাদুর সেই অন্ধ রাতের পর হাসতে ভুলে গিয়েছিলো চাঁদ
ভয় হিম হিম – জানি না কেন – বইছিলাম অন্যের অপরাধ
সময় হাঁটে, দিন গুনি, একটু করে মানুষের চোখ চিনি
বিপদসীমা জেনে মেনে, দিনে দিনে অনেক সাবধানী
দুই যুগ কেটে গেছে – ফিরে পেতে নিজেকে আমার
কত চাঁদ চলে গেছে হেসে, হয়নি সাহস, ছুঁই একবার
ভয়ে ভয়ে আধা-জীবন – সংসার, সন্তান – নিজের অন্তরীপ
তবু আমার মেয়ের শিয়রে রেখেছি – নিভু নিভু সাহস প্রদীপ
আজ –
আমার মেয়েরা আকাশ দেখে
ওদের দেখে চাঁদ হাসতে শিখে
ওদের দিয়ে দিয়েছি – আমার অসমাপ্ত রূপকথা
সাহসের আগুনে ওরা পুড়ে দিয়েছে সব চুপকথা
মুখরা প্রতিবাদে ভেঙেছে সাবেকী নিষ্ফল নীরবতা
ওরা এখন –
কৃষ্ণা পঞ্চমীর অন্ধরাতে জ্যোৎস্না দিয়ে ফানুস বানায়
ভেনাসকে টুইট করে রঙ ফর্সার ক্রিম ফেরত পাঠায়
মেঘের পালক ছুঁয়ে ওরা বলে –
আমি হাসলেই – হেসে ওঠে শুকতারা, চাঁদের ছুটি ফুরায়
আমি ফনা তুললেই – পিশাচরা সব ব্যাঙ হয়ে গর্তে লুকায়