উঠোনের এক পাশে ফুলেল শোভামণ্ডিত হলুদ বাসর। অপর পাশে লোহার পাইপ দিয়ে তৈরী আধুনিক মরণ খাটিয়া। ফুল আর আগরবাতির ঘ্রাণ মিলেমিশে বাড়িময় কেমন যেন বিদঘুটে গন্ধে ভরে গেছে। দোতলা বাড়িটির সামনে একটুরো উঠোনের সবটা লোকে লোকারণ্য। নানা বয়স আর বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণের মানুষ। হলুদ বাসরে অংশ নিতে যে মেহমান এসেছিলো, তারা এক এক করে চলে যাচ্ছেন। নতুন করে যারা আসতে শুরু করেছে, তারা কেউ দাওয়াতি নয়। কারণ মরা বাড়িতে দাওয়াত দিতে হয় না। খবর শুনলেই ছুটে আসে মানুষ। আত্মীয় কিংবা প্রতিবেশী, মুর্দাকে এক নজর দেখতে সবাই ছুটে আসে। যারা একদিনের জন্যেও এ বাড়ি মাড়ায়নি, অথবা মান-অভিমানের দেয়াল ছিলো- তারাও ছুটে আসে স্বেচ্ছায়। বলা হয়- এইতো শেষ দেখা। মুর্দা’র মুখটা দেখে কেউ চলে যায়, কেউ থাকেন দাফন না হওয়া পর্যন্ত। তারা মুর্দার আত্মীয় নয়তো নিকটতম প্রতিবেশী। অথচ বিয়ে বাড়িতে দাওয়াত ছাড়া কেউ আসে না। দাওয়াত না দেওয়া নিয়েও মনক্ষুণ্নতা দেখা দেয়। জীবন কী এক অদ্ভুত বাজি খেলা!
বেপারী বাড়ির উঠোনে এখন দুই প্রকারের মানুষ। এক- দাওয়াতি, আরেক- দাওয়াত বিহীন। উঠোনের মাঝ বরাবর বাঁশের খুটিটা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। তাতে বেঁধে রাখা বড় আকৃতির গোলাকার বাতিটাও বেকার থেমে আছে। অথচ কিছু আগে বাতিটা পৃথিবীর মতো ঘুরে ঘুরে বাহারি রঙের আলো বিলিয়েছে। জোনাকপোকার মতো ক্ষুদ্র বাতিগুলো ক্লান্তিহীন জেগে আছে শুধু। আগের মতোই মেতে আছে আলো-অাঁধারির খেলায়। কালো কপাড় মোড়ানো সাউন্ডবক্স দু’টো নিশ্চুপ। একটু শব্দও তার থেকে ভেসে আসছে না। সেই বিকেল থেকে বিরতিহীন উচ্চ আওয়াজে পাড়ার মাটি আর ভবনের দেয়ালে তারা ঝংকার তুলেছিলো। একটা অপ্রত্যাশিত মৃত্যু- সারাটা বাড়িজুড়ে কেমন যেন অদ্ভূত নিরবতা ঢেলে দিয়েছে। নিচতলার প্রতিটি কামরায় কান্নার মিছিল আর পাথরচাপা ক্ষোভের দীর্ঘশ্বাস। পুরুষের চেয়ে মেয়েদের গলার আওয়াজটা একটু বেশিই শোনা যাচ্ছে। অথচ উপরতলায় কোনো শব্দ নেই। ড্রইংরুমে মুখ ভার করে বসে আছে গোটা বিশেক ঘরকুটুম আর আগত মেহমান। মেয়েগুলো হলদে শাড়িপরা। তারা পার্লার থেকে মেকাপ করে আসা গাল দুটো ফুলিয়ে বসে আছে। ছেলেরা আপাতত মোবাইল হাতে গেইমস আর ফেসবুকিং করে সময় গুনছে। একটা মৃত্যু তাদের সমস্ত স্বপ্নকে নিষ্প্রাণ করে দিলো। নইলে পুরো বাড়িটা এখন নাচ-গান আর উৎসবে মেতে থাকতো।
উপস্থিত সকলের নিরবতা ভেঙ্গে দিয়ে রাশেদ বলে উঠলো– ‘বুড়িটা আর মরার সময় পেলো না। যেন খোদার কাছে পণ করেছে- একদম বিয়ের দিনেই তার মরতে হবে।’ রাশেদের এমন তেতো কথায় কারো যেন দ্বিমত নেই। যদিও শতভাগ শিক্ষিত এই পরিবারের সবাই জানে- ‘মৃত্যুর উপর কারো হাত থাকে না, এটি সম্পূর্ণ স্রষ্টার অদৃশ্য নিয়মে হয়’। রাশেদ রাহিতার ইমেডিয়েট ছোট ভাই। আজ রাহিতার গায়ে হলুদ। রাশেদের পছন্দেই গায়ে হলুদের স্টেজে হলুদ বাসর লেখা হয়েছে। বোনের বিয়ে নিয়ে তিন মাসের প্রস্তুতি তার। গায়ে হলুদ, ভিডিও, ক্যামেরাম্যান, ডি-জে সাউন্ট এসব দায়িত্ব সে নিজ থেকেই কাঁধে নিয়েছে। রাশেদের সকল বন্ধু ম্যাচিং করে হলুদ রংয়ের পাঞ্জাবি পরেছে। অথচ একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা সব যেন মাটি করে দিলো। এ অবস্থায় তারাও কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। খেদোক্তি প্রকাশ করে ওদের মধ্য থেকে কেউ একজন বলে উঠলো- ‘কত আশা করে হাই সাউন্ডের ডি-জে আনলাম, ঢাকা থেকে ফুল এনে হলুদের স্টেজ সাজালাম।’ কথাটা শেষ না হতেই পেছন থেকে আরেকজন বলে উঠলো- ‘শুধু কি ডি-জে সাউন্ড? ইন্ডিয়ান বাজিগুলোর কথা কে বলবে! ছোট মামাকে হাত-পা ধরে ঢাকা থেকে বাজি আনিয়েছি।’ কিছুটা উত্তেজিত হয়ে আরেকজন বলে উঠলো- ‘আমি যে দুই বোতল ফরেন মাল আনলাম সেটার কী হবে ?’ কথাটা শেষ না করেই সে দাঁত দিয়ে জিব চেপে ধরলো। এ অবস্থায় ড্রইংরুমে উপস্থিত সকলে একে-অন্যের দিকে বার কয়েক তাকালো। রাশেদের বাবা কথাটা শুনেও না শোনার ভান করে আগের মতোই গালে হাত রেখে বসে রইলেন। তিনি জানেন যে, বর্তমানে বিয়ে বাড়িতে ছেলেরা একটু-অাঁধটু রঙিন পানি গিলেই থাকে। তবে এটা যে অভ্যাসে পরিণত হবে না, সেই বিশ্বাস তার আছে। কিন্তু ‘ফরেন মাল’ কথাটা শুনতেই রাশেদের দাদু একটু নড়েচড়ে বসলেন। মদ পানের একটা হাদিস মনে পড়লেও এই মুহূর্তে তার বলতে ইচ্ছে জাগলো না। ক্ষোভ আর শোকের মাত্রা বেশি হলে মানুষ অনেক সময় পাথর হয়ে যায়। সেটিই যেন ঘটেছে, এই উপরতলার মুরব্বীদের বেলায়। তবে ছোটরা এখনো অপেক্ষায় আছে লাশটা কতো তাড়াতাড়ি গোরস্থানে নেয়া হবে। কারণ সময়ের নৌকায় চড়ে রাত যে অনেক আগেই সন্ধ্যার বাড়ি ছেড়ে গেছে।
মায়ের মৃত্যুতে সালাম সহেব অনেকটা বাকরুদ্ধ। আজ বাড়িওলার একমাত্র মেয়ের গায়ে হলুদ। বাড়ির প্রথম মেয়ে। তাই আয়োজনটা ব্যাপক পরিসরে হবে এটাই স্বাভাবিক। এমন আনন্দের অংশীদার হতে ভাড়াটিয়া হিসেবে নিজেও প্রস্তুতি কম ছিলো না। কিন্তু এমন দিনে মায়ের মৃত্যুটা সালাম সাহেবকে কিছুটা হলেও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে। এই প্রথম নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে সমগ্র পৃথিবীতেই সে একজন ভাড়াটিয়া মাত্র। যেখানে প্রতিটা পদে পদে নানাবিধ নিয়মের মধ্যেই চলতে হয় তাদের। উচ্চস্বরে কথা না বলা, খুব বেশি আমোদফূর্তি না করা, পানি বেশি খরচ না করা, বিদ্যুৎ অপচয় না করাসহ বিভিন্ন নির্দেশনা মেনেই সালাম সাহেব বাড়ি ভাড়া নিয়েছে।
মৃত্যুর খবর পেয়ে তার বড় ভাই সপরিবারে ছুটে এসেছে। মায়ের প্রতি প্রচণ্ড টান থাকলেও বউয়ের ঘোর অপত্তিতে দু’ভাইয়ের যৌথ পরিবারে থাকা হয়নি। শুধু তাই নয়, মা বেঁচে থাকতে খুব একটা খোঁজ-খবর রাখেনি তারা। আজ বাড়িতে প্রবেশ করেই ভাইয়ের স্ত্রী-সন্তানরা বিলাপ করে কাঁদছে। সালাম সাহেবের বুঝতে বাকি নেই এই কান্না কেবলই লোক দেখানো। কিন্তু এতে কিছুই করার নেই তার। কাউকে সেবা-যত্ন করা কিংবা তার মৃত্যুদিনে উচ্চস্বরে বিলাপ করা একান্তই যার যার ব্যক্তিগত বিষয়।
রাহিতা মুখ ভার করে বসে আছে। ইশানকে ফোন করবে বলে বার কয়েক সেলফোনটা হাতে নিয়েও রেখে দেয়। নানান ভাবনায় তারও ভীষণ মন খারাপ। নিশ্চয়ই ছেলেপক্ষ এতক্ষণে তাকে অপয়া বলছে। এই প্রথম নিজেকে সত্যিই অপয়া মনে হচ্ছে তার। নইলে এমন সুন্দর দিনে অপ্রত্যাশিত ঘটনাটি ঘটবে কেনো। আজকে তার জন্যেই তো ইশানদের বাড়ির আনন্দটাও থেমে আছে।গায়ে হলুদে অনেক বড় আয়োজন ছিলো ইশানদের। হলুদে এ্যাটেন্ড করতে ওদের আত্মীয়রা আগেই না কি চলে এসেছে। কথাগুলো ইশানই তাকে জানিয়েছে। এই বিয়েটা পারিবারিক হলেও রাহিতার সাথে ইশানের দুই বছরের পরিচয়। দু’জন একই প্রতিষ্ঠানের দুই বেঞ্চে চাকুরি করে। সেই থেকে অল্পস্বল্প প্রেমও গড়ে ওঠে দু’জনার। ইশানকে ফোন করা নয়, বরং সে ফোন করলে কী উত্তর দেবে আপাতত সেটিই ভাবছে রাহিতা।
এদিকে লাশ দাফনের ব্যবস্থা করতে সালাম সাহেবকে তাড়া দিচ্ছেন প্রতিবেশী মুরব্বীগণ। তাদের যুক্তি, মুর্দাকে বেশিক্ষণ উপরে রাখতে নেই। সালাম সাহেব কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেলেন, মুর্দার গোসল নিয়ে। কারণ, শহুরে বাড়ির ছোট্ট একটু উঠোন। তাছাড়া রাত পোহালে বাড়িওয়ালার মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান। বরযাত্রী আর দাওয়াতী মেহমানের জন্য উঠোনেই খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। বাড়ির সামনের রাাস্তাটা কিছুটা প্রশস্ত হলে সেখানেই মুর্দা’র গোসল দেয়া যেতো। চিন্তা ক্রমেই ঘাঢ় আর ঘনীভূত হচ্ছে। মুর্দার গোসল বলে কথা। সালাম সাহেব স্থির হলেন, উঠোনে গোসল দিতেই বাড়িওয়ালার কাছে অনুমতি চাইবেন। কিন্তু এমন মুহূর্তে তার সামনে দাঁড়াতে খুব লজ্জা করছে। অনেকটা বাধ্য হয়ে বড় ভাইকে পাঠালেন অনুমতি চাওয়ার জন্যে।
কালাম সাহেব সিঁড়ি বেয়ে দো’তলায় উঠতেই চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পেলেন। রাশেদ উত্তেজিত গলায় বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলছে- ‘ওরাতো আমাদের পরিবারের কেউ না। একজন ভাড়াটিয়ার মৃত্যুর জন্যে আমাদের সব আয়োজন বিফলে যাবে? তুমি বরং শিগ্রই গিয়ে বলো লাশটা যাতে এক্ষণই গোরস্থানে নিয়ে যায়। লাশের গোসল যেন এ বাড়িতে না দেয়। তাদের মায়ের মৃত্যুর জন্যে তো আমার বোনের বিয়ে বন্ধ করা যাবে না।’ রাশেদের বাবা কিছুটা নরম গলায় বললো- আগে তো লাশটা গোরস্থানে নেয়া হোক। তারপর না হয় ঘরের মধ্যেই হলুদের কাজটা সেরে ফেলবো। তবে দেখিস, কোনো প্রকার গান-বাজনা কিন্তু করা যাবে না। তাহলে এলাকায় আমাদের বদনাম ছড়িয়ে পড়বে।
রাশেদের দাদু কিছুটা আমতা আমতা করে বলতে লাগলেন- ছেলেপক্ষের সাথে কথা বলে বিয়েটা দু’দিন পিছিয়ে নেয়া যায় না? ভাড়াটিয়া হলেও আমরাতো একই বাড়ির মানুষ। কথাটা শেষ না করতেই রাশেদ ফুঁস করে চেঁচিয়ে উঠলো- ‘তুমি এটা কি বললা দাদু, ওদের জন্য আমার বোনের বিয়ে পিছিয়ে দেবো?’ রাশেদের এমন কথায় তার দাদু রেগে গেলেন। বেছারা বুড়ো মানুষ। বয়সের ভারে একেবারে নুব্জ্য। তাই আগের মতো খুব একটা জোরে কথা বলতে পারেন না। তাছাড়া স্ট্রোকের রোগী। চিকিৎসক জানিয়েছেন, উচ্চস্বরে কথা বলা কিংবা উত্তেজিত হওয়া তার জন্যে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। দাদা-নাতির কথা কাটাকাটি দেখে কালাম সাহেব আর সামনে পা বাড়াতে সাহস করলেন না। হাতের উল্টোপিঠে চোখ কচলাতে কচলাতে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসেন। ভাইকে অশ্রুসিক্ত ফিরতে দেখে সালাম সাহেব আর প্রশ্ন করেলেন না। মোবাইল হাতে ওপাশের কাউকে জানিয়ে দিলেন মুর্দার গোসল বাড়িতে হবে না।
হঠাৎ উপরতলা থেকে সমবেত স্বরে চিৎকার শোনা যায়। সবাই কান পেতে চিৎকারের বিষয়টা পরিস্কার হওয়ার চেষ্টা করছেন। এবার নারীদের সাথে পুরুষের বিলাপও শোনা যাচ্ছে। আচমকা হন্তদন্ত হয়ে রাশেদের উপস্থিতি। সালাম সাহেব আগ্রহী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন- ‘কী হয়েছে, রাশেদ?’ রাশেদ কান্নামাখা কণ্ঠে জানায়, ‘কাকু তোমার যে আত্মীয় অ্যাম্বুলেন্স চালায় তার ফোন নাম্বারটা তাড়াতাড়ি দাও। সালাম সাহেব আবারও জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হয়েছে, রাশেদ?’
‘দাদু স্টোক করেছে’ কথাটা বলেই রাশেদ ফু্ঁফিয়ে কেঁদে ওঠে।