খণ্ডিত আমি
এই যে থমথমে আকাশ হিমশীতল বাতাসের চলাচল
মাঝেমাঝে দু-চার ফোঁটা বৃষ্টি
কাদা ওঠা পথঘাট
এর মাঝে উতপ্ত এজলাসে ফাঁসির আদেশ
কিংবা ধরো লাল সাদা মরিচআলোয় সজ্জিত রাধাচূড়া
বেতসকাঁটার ঝোপে প্রণয়ে জর্জরিত সন্ধ্যে
আর রাতের সন্ধিক্ষণ
এই যে পায়ের তলায় ক্ষয়ে যাওয়া
রিক্সার প্যাডেল
কড়া পড়া নগ্ন পা
রুগ্ন নিয়ম কানুন
কেউ হেঁটে হেঁটে ছুটে ছুটে দাঁড় করাতে পারে নিজের সামনে নিজেকে
কেউ ষোলআনা বুঝে যায়
চেপে আসা চারটি দেয়ালের নিষ্পেষণে
এখানে এক একটি জীবন
এক একটি বিস্ময়কর পৃথিবী
যেন এই জীবনগুলোর প্রতিটিই আমি
এই পৃথিবীগুলিও এক একটি খণ্ডিত আমি
এখানে চোখ পেতে হতবাক
নিজের প্রতিচ্ছবি দেখি
গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত পরিযায়ী পাখির অবয়বে।
প্রত্যাহিক
প্রতিদিন যে লোকটি নষ্ট মনিটর
নষ্ট টিভি, মোবাইল, ব্যাটারি
কিনবে বলে হেঁকে বেড়ায়
একদিন তাকে গিয়ে বললাম,
নষ্টগুলো কতবার হাত বদল হলে ঝকঝকে তকতকে নতুন জীবন পাই বলতে পারো?
সংসারের এতো খুঁটিনাটি নষ্ট কিনে যে মানুষ,
তার কাছে কেন তুমি বেচে দাও না তোমার নষ্ট জীবন?
লোকটি এক মুখ হেসে বললো
নষ্ট কিনে কত কত হাসি ফোটাই
ওদের কষ্টে ভরা জীবনে
মানব জীবন ধন্য যে হয়
নষ্ট জীবন সাধনে
তোমাকে জানতে
কৃষ্ণ পক্ষের হাত ধরে
হাতিরঝিলে ঝুপঝাপ সন্ধ্যা নামলে
আমি রূপার মত কদম ফুলের ঘ্রাণ পাই ভরা কার্তিকে
আবছা অন্ধকারে মিসির আলীর মত নিমগ্ন হই
নিজের ভেতর
হিমুর মত নগ্ন পায়ে হেঁটে চলি শাহবাগের অলিগলি রমনা থানা থেকে পুরান ঢাকা…
অন্ধকার ভেদ করে দেখি আহসান মঞ্জিলে
কাচের চুড়ির মত রিনঝিন বাজছে নৃত্যরত একঝাঁক তরুণী
কখন যে আমিও মিলেমিশে একাকার হই
ওদেরই সাথে,
আর রসূনের খোসার মত
ফিনফিনে পাঞ্জাবি ভেদ করে দেখি তোমার বুক
সূর্যমুখীর মত কালচে খয়েরি বৃত্তের
পশম চুইয়ে ঝরেছে তোমার রক্ত
সেখানে কোন সম্রাট নেই জমিদার নেই
সেখানে আমি শুধু দেখি
ক্ষত বিক্ষত এক বাংলাদেশ!
হ্যা, তোমাকেই দেখি আমি বাংলাদেশ।
তোমাকে জানতে গিয়ে জেনেছি
একজন ধান চালের ব্যবসায়ী রবীন্দ্রনাথ কে
জেনেছি কেমন করে জমিদার পুত্র হয়ে
ওঠেন ফুল বিক্রেতা
তোমাকে জানতে গিয়ে জেনেছি
কারাগারের লৌহ কপাট ভাঙার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কবির
নির্জীব হয়ে যাওয়ার ইতিহাস,
পাঠ করেছি রক্তাক্ত প্রান্তর
রাহুল সাংকৃত্যায়ণ
পিতার আত্মজীবনী
তোমাকে জানতে হে বাংলাদেশ
এক একটি সর্ষের শীষে থাকা
আট দশটি দানা সংগ্রহ করে ভরে ওঠা গোলার কথা জেনেছি,
ঘামের কথা জেনেছি
অতঃপর গোলা লুট হয়ে যাওয়ার কথাও
জেনে ফেলেছি
তোমাকে জানতে গিয়ে আমিও হয়েছি স্বজনহারা
হয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশের শঙ্কর সন্তান!
আল মাহমুদ, লাল সালুর সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে
জানতে জানতে অথবা হারাতে হারাতে
আবারও হয়েছি পরাধীন স্বার্থান্বেষী ভয়ংকর
হয়েছি আত্মঘাতী সিলভিয়া পাথ
তথাপি অদম্য অজানাকে জানতে জানতে
পেছনে যেতে যেতে আঁতকে উঠেছি নিজের অজান্তে
তখনও ভরা নদী শীর্ণ হয়েছে
ভরা মাঠ দখল হয়েছে
বিনাশ হয়েছে বারোভূঁইয়া
রানা প্রতাপ সিংহের বীরত্ব গাঁথা
তবু তোমাকে যেন সবটুকুই অজানা থেকে গেলো
ও আমার প্রিয় স্বদেশ !
অথচ তোমাকে জানা হলে হয়তো বুঝতাম
পাহাড়ি ফুলের ভাষা
সাগরের ঢেউ এ লুকানো অমাবস্যার বেদন
মৈত্রী দেবীর উপাখ্যান…
তোমাকে জানা হলে
আমি টাইম ট্রাভেলিং করে এই উপমহাদেশের কালো বোর্ড থেকে
মুছে দিয়ে আসতাম দুই শত বছরের দাসত্বের ইতিহাস
মুছে দিতাম দুর্বিষহ বারোচোদা নামকরণ
পূর্ব পুরুষের এইসব দাগ মুছে ফেলতে পারলে
হয়তো পেতাম পিতার মত নিখাদ মানুষ
নিখাদ তোমাকে… আমার নিখাদ বাংলাদেশ কে।
বিবর্ণ জলে পোড়ে তৃষ্ণার শরীর
কৃষ্ণপক্ষের তিমির আকাশ
কখনো মাখন রঙা চাঁদ, কখনো বা
হৃদয় তোলপাড় করা চঞ্চল হরিণ সমুদ্র
দু চোখের পাড় জুড়ে,
তবু কেন বিবর্ণ জলে পুড়ে যায়
তৃষ্ণার শরীর!
কার উষ্ণতায় চাঁদ এমন আহলাদে
গলে গলে যায়-
কী করে জানবে মানুষ?
মানুষ যদি আকাশ হতে না পারে।
যে কখনো বুকের গভীরে সমুদ্রের গর্জন শোনে না,
কী করে সে মুক্তাক্ষর সাজাবে জলের বুদবুদ?
দ্বিধাহীন দুহাত পেতে ছিলাম সূর্যের কাছে
করতল জুড়ে রৌদ্রের চুম্বন
বন্ধ চোখে অন্ধকার, আলোহীন মুঠো।
ভালোবাসা টুপটাপ ঝরে যায়
আঁকড়ে থাকা আঙুল গলে
একরৈখিক জল
জগতে শুধু মানুষকেই কিছু একটা হয়ে উঠতে হয়
আমি অন্যের কাছে ক্রমশ একটা ধারণা হয়ে উঠছিলাম
অথচ আমি কখনো কারো কাছে
উম্মুক্ত করিনি আমার গোলাবারুদের কারখানা
কতটা আগ্রাসী অথবা যুদ্ধবাজ এটা বোঝার জন্য
কখনো কোন সাঁজোয়া ট্যাঙ্ক নামাতে হয়নি কাদা জলে
তবু কিছু দুর্মুখ ধারণার বশবর্তী হয়ে
আমাকে একথোকা ফুলই ভেবেছিল।
তারা তখনও জানত না
কিছু ফুল আছে পতঙ্গভুক, জীবননাশী।
আমি অবশ্য দু’টোর একটিও নই
আমি সকলের কাছে শুধু একটি অস্পষ্ট ধারণা মাত্র
আমি শুধু স্বচ্ছ টলটলে জলই হতে চেয়েছিলাম
অদম্য দুর্বার একরৈখিক জল।