আড্ডাপত্র

১ মাঘ, ১৪৩১; ১৫ জানুয়ারি, ২০২৫;বিকাল ৪:০৯

মাহফুজা অনন্যা’র কাব্যগ্রন্থ ll এবং নাভির কান্না

আড্ডাপত্র

অক্টো ২২, ২০২০ | কাব্যগ্রন্থ

এবং নাভির কান্না

লেখক : মাহফুজা অনন্যা
ধরন : কবিতা
প্রকাশক : বেহুলা বাংলা
প্রচ্ছদ : শ.ই. মামুন
প্রকাশকাল : ২০২০
মূল্য : ২২৫ টাকা

পাঠমূল্যায়ন: মামুন অপু

কবিতা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিল্প। কবিতার জালে নক্ষত্রের মত জ্বলে ওঠে গভীর বোধের এক মহা মূল্যবান রত্ন। কবি মাহফুজা অনন্যার কবিতার বই “এবং নাভির কান্না” চমৎকার কবিতা দিয়ে সাজানো গোছানো একটি কাব্য।
আমরা জানি, কবিতা প্রখর বোধ থেকে জন্মায়। যার বোধ শক্তি যত তীক্ষ্ণ; তাঁর কবিতাও তত গভীর। কবি মাহফুজা অনন্যার লেখা “এবং নাভির কান্না” অত্যান্ত মনোযোগ দিয়ে পড়লাম। পড়ে মনে হলো, সত্যিই তিনি কবিতা লিখতে পারেন এবং মমতা দিয়ে প্রতিটি লেখার অঙ্গসৌষ্ঠব ভিন্ন ভিন্ন কারুকাজে রুপায়িত করতে জানেন নিজস্ব শব্দের ওজস্বীতায়। কবিতায় বিভিন্ন দর্শন, রূপক, কাব্যালঙ্কার, অর্থালঙ্কার, ইমাজিনেশন এবং কবিতার সাথে সম্পর্কিত সকল দিকই কবিতার দেহে সুনিপুণ কলমে গেঁথেছেন অনন্য স্টাইলে।

প্রতিটি কবিতাই স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। প্রেম, দ্রোহ, হাসি-কান্না, মন ও দেহের কামনা, জীবনের উল্লাস, তিক্ততা, বর্তমান, দেশ, সমাজ, জাতি, ধর্ষণ প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিঁনি অনুভব করেছেন স্বতন্ত্র ভাবনায়।

“এবং নাভির কান্না” কাব্যগ্রন্থ থেকে আমরা কিছু খণ্ড অংশ দেখবো বিভিন্ন বিষয়ের উপর।

কবিরা প্রেমকে উপভোগ করে কল্পনা এবং বাস্তবতার সংমিস্রণে। কবি তাঁর কবিতায় প্রিয় মানুষের ঠোঁটের উষ্ণতা কামনা করেন হৃদয়ের সমস্ত আকুল প্রত্যাশা নিয়ে ‘চুমুকাব্য’ কবিতায়—

“পৃথিবীর শেষ আয়ুর নরনারীর মত ক্ষয়ে যাবো তবু
চুমুর আয়ুধ রেখা চলবে সমান্তরাল।”

আনন্দশোভা কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে হতাশা এবং দুঃখবোধ। তাঁর প্রেমিকের প্রতি অভিযোগ দিয়ে বলেন—

“বুকের আয়নায় তিলতিল করে গড়েছি যে প্রাসাদ
সেই প্রাসাদে স্বপ্ন সাজাতে তোমার ছিলো ভীষণ ভীষণ বাঁধ।”

কবির স্মৃতিতে প্রিয় মানুষ সবসময়ই নক্ষত্রের মত জ্বলতে থাকে, ফুলের সৌন্দর্য এবং ঘ্রাণ ছড়াতে থাকে। তাই কবি ‘আঁধারের ইতিবৃত্ত’ কবিতায় বলেন—

“তেমন করে আমিও তোমাকে এক মূহুর্ত ভুলি না
আঁধারের প্রচ্ছদে লেপন করি তোমাকে—”

প্রেমিক-প্রেমিকা একে অপরকে প্রত্যাশা করবে না একান্ত কিছু সময় কাটানোর জন্য, এটাও কী সম্ভব! মোটেই সম্ভব নয়। তাই কবি ‘রুপান্তর’ কবিতায় লেখেছেন—

“দুটি দেহের নতুন এক রুপান্তর
ইন্দ্রিয়ের সবচেয়ে বিশুদ্ধবাঁকের মিলনে হয়ে উঠি একে অপরের আয়না।”

দুর্নিতিবাজ নেতা আমলাদের সবাই তোয়াজ করে চলে। কিন্তু প্রকৃত কবিরা বিপরিত। তাঁরা সত্যকে প্রকাশ করে মিথ্যুকের গালে চপেটাঘাত করে। তাই কবি বিদ্রুপের সাথে বলেছেন…

“দেওয়ালে টাঙানো রাজনৈতিক পোস্টার ও নেতার ছবিতে আয়েশ করে হিস্যু করে
আর বাঁকা চোখে হাসে করুণার হাসি—”

একটি কবিতার নাম ‘এবং নাভির কান্না’। এই কবিতার শিরোনামটাই করেছেন কাব্যগ্রন্থের নাম করণ। এই বিশেষ কবিতাটি সত্যি অসাধারণ। বর্তমান সমাজে অথবা আমাদের আশেপাশে দেখি, কাছের মানুষই ধর্ষক, হত্যাকারি, প্রতারক। কবি মূল কবিতাটিতে তাই প্রকাশ করতে চেয়েছেন। কবি বলেন…

“একদিন আবছা ঘুমের ভেতর দেখি
কালো কুকুরটি ঘনপায়ে লেজ নাড়িয়ে পায়চারি করছে
আর কিছুক্ষণ পরপর আমার শরীরের গন্ধ শুকছে।

প্রায় একই বিষয় ‘অবক্ষয়’ কবিতায় লিখেছেন ভিন্ন স্বরে…

“গাঢ় রাতের প্রলেপে ঢাকা যায় কি কলঙ্ক,
ধর্ষণের দাগ, হৃদয়ের ক্ষত?”

কবি সর্বদা হতে হয় দেশ প্রেমি। কবিতায় থাকবে স্বাধিন চেতনা। কবি এ ক্ষেত্রে জোরালো প্রতিবাদ করেছেন মৌলিক অধিকারের দাবিতে। ‘টিকটিকি ও আরশোলাদের অট্টরোল’ কবিতার শেষে লেখেন…

“প্রথমে ভয় পেলেও বুকে ফুঁ দিয়ে হাতগুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলাম,
হাতগুলো আমার চেনা
পূর্বপুরুষ ও প্রপিতামহের হাত
তাদের প্রত্যেকের বৃদ্ধাঙুলের নখের উপরে ভোটকেন্দ্রের কালচে নীল কালির সিল….!”

স্বাধীনতা এবং গনতন্ত্র নিয়ে লিখেছেন চমৎকার একটি কবিতা। যে কবিতাটি পাঠক হিসেবে সেরা বলেই মনে হয়েছে আমার। স্বাধীনতা কবিতায় বিদ্রুপের সাথে লেখেন…

“স্বাধীনতা এদেশের ষোল কোটি মানুষের আহত কপাল
কিংবা মফস্সলে গজিয়ে ওঠা জংধরা অস্ত্রে চেংড়া সন্ত্রাস,”
এছাড়া ‘মানচিত্র খেতে চাই না’ কবিতায় লেখেন…
“আমি নরপশু, ঘাতক, খুনি, ধর্ষকের ঘৃণা করতে চাই
নিরবে, নিকৃষ্ট উপায়ে নয়, প্রকাশ্যে নিন্দা করার স্বাধীনতা চাই।”

একটি কাব্য গ্রন্থের প্রতিটি কবিতাই সমান নয় মান এবং ভাবের বিভিন্ন দিক থেকে। এক্ষেত্রে এই কাব্যগ্রন্থটিও ব্যতিক্রম হবার জো নেই। অসাধারণ পঙক্তি যেমন আছে; কিছু দুর্বল কবিতাও লক্ষ করা গেছে । পৃথিবীর বেশির ভাগ কবি সাহিত্যিকরাই একথা স্বীকার করে থাকেন যে, তাঁদের কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতাই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। শত চেষ্টার পরও কিছু দুর্বল লেখা স্থান নিয়ে নেয়। পরবর্তি সময়ে দেখা যায় কিছু দুর্বল কবিতাও শ্রেষ্ঠ কবিতার খেতাব অর্জন করে।

সবশেষে বলতে পারি, “এবং নাভির কান্না” কাব্য গ্রন্থের লেখক মাহফুজা অনন্যা একজন সৃষ্টিশিল কবি। তার সৃষ্টির বৈচিত্র্য এবং ভাবে আরো নতুনত্ব দিয়ে আমাদেরকে নিয়মিত চমকে দেবেন, এটাই প্রত্যাশা করি। কবির জয় হোক, কবিতার জয় হোক।

Facebook Comments

আড্ডাপত্রে লাইক দিন

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১
১৩১৫১৬
১৯২০২১২২২৩২৪২৫
২৬২৭৩০৩১