সোয়েব সাইফীর গল্পের মতো উপন্যাসও রহস্যময়। একটি ছায়াভাষার ভিতর দিয়ে তার কল্পনায় ভাষার সফর করতে হয়। দর্শন, ধর্ম, জীবন, জগৎ ও পরজগতের আলো-আঁধারির ভিতর অয়ংচির চরিত্ররা বিচরণ করে। সাইফীর ভাষা সরল তবে বিষয় গভীর। ছোট ছোট বাক্যের ভিতর গল্পের উত্তেজনা বিরাজমান।অয়ংচি ‘রিটার্ন টু এনাদার ওয়ার্ল্ড আফটার ডেথ।’ আড্ডাপত্রের প্রথম ধারাবাহিক উপন্যাস। একজন তরুণকে তুলে ধরতে পেরে আমরা আনন্দিত।
চার.
‘Open your eyes, I said open your eyes’..
কৌশিক চোখ মেলে তাকালো।
আজকাল কিছু হয়েছে, যেখানে সেখানে ঘুমিয়ে পরছে। সে বসে আছে বেয়ন্ড মার্কেটের বারান্দায় অন্ধকারে একলা। মার্কেট বন্ধ হয়েছে দু’ঘন্টা হয়। পাশের পাথর ক্ষয়ে যাওয়া রাস্তা ডুবে আছে হলদে আলোয়। সে রাস্তায় সংসার চিন্তায় মগ্ন মানুষেরা ঘরে ফিরছে শ্রান্ত পায়ে। তাদের ঘিরে আছে রাতের নিস্তব্ধতা। রাত এখন ১১:৪৬ মিনিট।
“আল্লাহু আকবার, আল্লাহ্ আকবার.. আল্লাহু আকবার, আল্লাহ্ আকবার..”
ইট কাঠের বহুতল ভবনের ফাঁকে অন্ধকারে একলা চাঁদ। জোছনা ঝরছে না সোডিয়াম আলোর শহরে। কৌশিক ভাবে, শহুরে কৃত্রিমতা মানুষকে বিশুদ্ধ সৌন্দর্যতা থেকে বঞ্চিত করছে, ভবিষ্যতেও তাই করবে। শূন্য নিঃশ্বাস নেমে যায় বুক থেকে।
করুণ কন্ঠ আবারো শোনা যায়, ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহ্ আকবার.. আল্লাহু আকবার, আল্লাহ্ আকবার’..
আজান দেয় কে, বিবিজান? অসুস্থ ছেলে কি মারা গিয়েছে? মানুষ মরলে পৃথিবী আজান দেয় না। কিন্তু সন্তান মরলে পাগলপাড়া মায়ের বেদনা কে বোঝে।
আবারো শোনা যায় অধরা কন্ঠ।
কৌশিক এগিয়ে গিয়ে আলোতে দাঁড়ায়। মার্কেটের ঠিক পেছনে চার রাস্তার মোড়। ঝাপসা আলোয় এখনো জেগে আছে মানুষের ভীড়, বেচাকিনি। ভীড়ের পাশে একটি স্কুল ভ্যান দাঁড়িয়ে। ভ্যানটা দুলছে। হেলেদুলে দু’পাশে ক্রমাগত দুলছে। একজন.. দু’জন.. ভীড় জমে যায় ভ্যানের চারপাশে। আলুর বেপারী চেচিয়ে বলে, ‘কি হয়ছে, ভ্যান ওবা লইরছে কেন?’
‘ল্যাংটা বাবাক জীনি ধরিছে।’
‘কইশ কী!’
আলুর বেপারী দোকান ফেলে লাফিয়ে গেলো। ল্যাংটা বাবা পাগলের মতো ভ্যান থেকে বেরিয়ে এলো। ‘দূরে যা.. দূরে যা’..
উৎসুক জনতা নড়েচড়ে না। ঘটনা বেগতিক দেখে জনতার গায়ে বাবা পেশাপ করে দেন। উৎসুক জনতা তবু নড়েচড়ে না।
আলুর বেপারী ল্যাংটা বাবার পায়ে ঝাঁপিয়ে পরলো। ‘এ জেবন তোমার পায়ে বাবা.. বড় কষ্ট বাবা, বড় কষ্ট..’
‘দূরে যা.. দূরে যা হারামীর বাচ্চা’..
‘আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’..
সত্যিই কী কেউ আজান দিচ্ছে, নাকি ভুল শুনছে! দ্রুত হেঁটে মার্কেটের বিপরীত গলিতে এগিয়ে যায় কৌশিক। গলির ভেতর ইমার্জেন্সি লাইট ত্রুটিপূর্ণ কারণে জ্বলছে নিভছে। তার নিচে দাঁড়িয়ে এক মহিলা নামাজ আদায় করছে উচ্চ স্বরে। মহিলাটি ‘দক্ষিণে’ মুখ করে নামাজ পড়ছে। থেকে থেকে সাদা কাপড় টেনে শরীর ঢাকবার চেষ্টা করছে, ছেঁড়া কাপড়ে তবু হাতের কনুই বেরিয়ে যায়।
মহিলাকে কৌশিক চিনতে পারে। দেখা হয়েছিলো চায়ের দোকানে। নিষ্পাপ হেসে বললো, ‘একটা চা খাওয়াবি?’
চা-বিস্কিট খেয়ে বললো, এইবার একটা ‘টাইগার’ খাওয়া।
টাইগার খেয়ে বললো, ‘দশ ট্যাকা দে, শাড়ী কিনুম। দেহস না ছিড়া গেছে!’
দোকানি বললো, ‘দিয়েন না ভাইজান, অ’রে যত দিবেন তত চাবো।’
কৌশিকের চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। মহিলাটি সেজদায় পড়ে কাঁদছে। বুক কেঁপে ওঠে কৌশিকের। কাঁপা পায়ে গলি হতে বেরিয়ে দেখে, স্তব্ধ শহরের হলদে আলো এখনো জ্বলে আছে।
সরকার পরিচানার জন্য বহু গোয়েন্দা ছদ্যবেশে বাস করে মানুষের ভীড়ে। এসব ছদ্যবেশীরা সরকারকে সহযোগিতা করে তথ্য দিয়ে। সাধারণ মানুষ এদের বলে ‘টিকটিকি’। টিকটিকি থাকে আন্তর্জাতিক আইনী সংস্থায়। টিকটিকি পোষে বেআইনী সংগঠনগুলোও। কর্ম ক্ষেত্রেও বাস করে টিকটিকি। কর্মক্ষেত্রের টিকটিকিকে বলে ‘তেলবাজ’। বড় কর্মকর্তারা পছন্দের এসব তেলবাজদের গোয়েন্দা হিসেবে ব্যবহার করে ‘চেয়ার’ ধরে রাখবার জন্য। আচ্ছা, পৃথিবীর স্রষ্টা কি গোয়েন্দা পাঠান মানুষের ভীড়ে, আমাদের পরীক্ষা করার জন্য? যারা বিভিন্ন ছদ্য বেশে আসে আমাদের সামনে- কখনো ভিখেরী, কখনো পাগল, কখনো বা অন্য কোন বেশে?
পাঁচ.
“তিনি হৃদয় সমূহের গোপন রহস্য জানেন। তোমরা ভালোভাবে জেনে রেখো, দুনিয়ার জীবনতো খেল-তামাশা, জাঁকজমক, পারস্পরিক অহংকার প্রকাশ, ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি প্রাচুর্য লাভের প্রতিযোগিতা ব্যতীত আর কিছুই নয়; এর উপমা হলো বৃষ্টি, যার দ্বারা উৎপন্ন শস্য কৃষকদের চমৎকৃত করে। অতঃপর শস্য শুকিয়ে যায়, ফলে তুমি ওটা হলুদ বর্ণ দেখতে পাও, অবশেষে তা খড় কুটায় পরিণত হয়। দুনিয়ার জীবনতো ছলনাময় ধোকা ব্যতীত কিছুই নয়।”
অদ্ভুত, কী অদ্ভুত পবিত্র লিলান। অন্ধ ব্যক্তির মতন অক্ষর স্পর্স করে কোরআন পাঠ করছেন আধো অন্ধকারে। মেঘের আড়ালে লালচে আভা ফুটে আছে আকাশে। সেই আভার নিচে পড়ে আছে অয়ংচি। হিমেল বাতাসেও কেমন দরদরিয়ে ঘামছে!
‘অয়ংচি অমন ঘামছে কেন?’
পবিত্র লিলান আল কোরআন হতে দৃষ্টি সড়িয়ে অয়ংচির মুখে তাকায়। ‘ওকে ডেকে তোলো, সময় হয়েছে নিদ্রা জাগরণের।’
বুমেরাঙ পুনঃরায় বিদিক হয়ে পড়ে। ‘ওঠো, ওঠো অয়ংচি, দেখো কেমন ভোর হয়ে গেছে। ওঠো বন্ধু’..
দেহ কেঁপে ওঠে অয়ংচির।
‘তুমি কি সপ্ন দেখছিলে?’
অয়ংচি কথা বলে না। গোল গোল চোখে তাকিয়ে রয়। দৃষ্টিতে ভয় বিষ্ময় জড়ানো। ভাসা ভাসা কী যেন মনে পরছে। এক পাগলী দক্ষিণে মুখ করে নামাজ পরছিল, চারপাশের আলো একবার নিভে গিয়ে আবার জ্বলে উঠছিল। ‘পবিত্র লিলান, দেখেছি.. আমি সপ্ন দেখেছি।’..
ছয়.
সপ্ন হলো বাস্তব এক ভ্রমণ।
যেমনটা আমরা জেগে থেকে দেখি। ঘুম ভাঙা অবধি বুঝি না আমরা সপ্নে কী বাস্তবে। নিজের লাশের পাশে বসে কাঁদলেও অবাস্তব মনে হয় না তখন। কাঁটাতারে বেঁধে শরীর ছিন্নভিন্ন। তবু দৌঁড়ে পালাচ্ছি রাতের আঁধারে। ঘুম ভেঙে বুক ধুকপুক করে, ‘বড় বাঁচা বেঁচে গিয়েছি এবারের মতন!’ যদিও সপ্নে যা ছিলো বাস্তব এক ভ্রমন।
সপ্ন-ভ্রমনে ভুলে যাই বাস্তব জীবনের কথা। ভুলে যাই বাস্তব জীবনের পেরেসানের কথা। আচ্ছা, কেন সপ্ন বাস করে ঘুমের মাঝে? কেন সপ্ন নামের অস্তিত্ব রয়েছে মানব মনে? হতে পারে কি, এর উল্টো পিঠে অন্য রহস্য লুকিয়ে?
‘দুনিয়াবী’ সাধারণ ধারণা ভুলে গভীরে যাই।
অনেক সময় সপ্ন মাঝে দেখি অন্য আরেকটি সপ্ন। দেখি তৃতীয় জীবনের গল্প। তৃতীয় জীবনের গল্প নিয়ে পন্ডিতেরা সন্দিহান, আমিও সন্দিহান। কিন্তু সন্দেহ গভীর হয় যখন Connective Thinking পাখা মেলে শক্তিধর হয়। অর্থাৎ দুটি ভিন্নধর্মী চিন্তা যখন একসুতোয় বাঁধা পড়ে।
যেমন- মানুষ ঘুমিয়ে দু’ সেকেন্ড হতে ত্রিশ মিনিট পর্যন্ত সপ্ন দেখে। এটি প্রমাণিত।
আর দয়াময় যেদিন বলবেন, ‘ছিলে কতটা ক্ষণ পৃথিবীতে?’
মানুষ বলবে, ‘অবশ্যই কিছুটা ক্ষণের বেশি নয়।’
এখানে দুটি ভিন্ন ধারনা বা চিন্তা এক সাথে মিলে যায়। This is connective Thinking.
অবাক লাগে, জানালার ও’পারের ঝকমকে রোদকে যখন সপ্নময় মনে হয়। বাস্তবিক এ মহাসপ্নের মাঝেই দয়াময় মানুষের পরীক্ষা নেন।
কিভাবে?
দয়াময় হলেন অতিব দ্রুত হিসেবকারী। তাঁর এতো সময় কোথায়? হিসেব নেয়া হচ্ছে বিশাল প্রান্তরে, সূর্য মাথার এক বিঘে উপরে, মানুষ বলছে ইয়ানফছি! হাহাকারের দিনে সিনেমার পর্দা ফেলে দেয়া হয়েছে দৃষ্টির সামনে। সেই পর্দায় মানুষ দেখে কালো আকাশে ঝড়ের দৃশ্য, দয়াময়কে ভুলে অন্তর্পণে লোভের রাজ্যে রাজ্য কায়েমের দৃশ্য, জেদ আর যন্ত্রণার গল্প। মানুষ ভুলে যায় তার বাস্তবিক অবস্থান।
দৃষ্টির পর্দায় দৃশ্য দেখানো হয়। মানুষ দৃশ্য দেখে। নগ্ন নারীর ভেজা শরীর দেখানো হয়। যদিও দয়াময় এটি হারাম করেছেন। আর এখানেই মানুষ পরীক্ষা দেয়।
অবাক লাগে, হাঁটতে গিয়ে ক’জন পায়ের দিকে তাকাই! দৃষ্টির পর্দায় একের পর এক ঘটনা ঘটে চলে। আমরা শুধুই ব্যস্ত থাকি সেই ছবিঘটনা সামলাতে গিয়ে।
চলবে..