প্রথম কাব্যগ্রন্থ, প্রথম কবিতা আড্ডাপত্র প্রকাশ করছে। প্রথম কাব্যগ্রন্থের সাথে কবির আনন্দ, উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি পাঠকের কানে নতুন কবিতার গুঞ্জরণ ভেসে আসে। পাঠকের মনে কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতাটি তুলে ধরতে চায় আড্ডাপত্র। কবিতা পাঠের সাথে সাথে জানবো কবি সম্পর্কেও। এই আয়োজনটি পরবর্তীতে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হবে]
প্রার্থনায় নম্র হও পাবে
খোন্দকার আশরাফ হোসেন
আমাকে পাবে না প্রেমে, প্রার্থনায় নম্র হও পাবে,
কামে-ঘামে আমি নেই, পিপাসায় তপ্ত হও, পাবে।
পাখিরা প্রমত্ত হলে সঙ্গিনীকে ডেকে নেয় দেহের ছায়ায়—
ছায়া নয়, রৌদ্রতাপ জ্বালাবার শক্তি ধরো, কেবলি আমাকে
তপ্তজলে দগ্ধ করো, রুদ্ধ ক্রোধে দীপ্ত করো, পাবে।
পৃথিবীর সর্বশেষ কবি আমি অহংকার আমার কবিতা
বিষাদে বিশ্বাসে পূর্ণ হৃদয়ের জলাধারে ধরো,
আমাতে নিবদ্ধ হও পূর্ণপ্রাণ ফলবন্ত হও—
আমাকে পাবে না ফলে, পরাগ-নিষিক্ত হও, পাবে।
আমি তো নিষিদ্ধ প্রেম, শুদ্ধ ব্যথা, বিষাক্ত আঙুর,
আমার বিষের দানা জিভে কাটো, রক্তরস যিশুর রুধির
পান করো, নতুন দানা প্রজন্ম সাধ তুঙ্গ করো, পাবে।
আমাকে পাবে না দুঃখে, একটি হতাশা শুধু পাবে।
ছুরির ফলায় জমা একফোঁটা প্রাকৃতিক স্বেদের মতোন
তীক্ষ্ণ করো, মূর্ত করো, পাবে।
তেত্রিশ বছর ধরে বুকের সন্তাপ জমা সে সন্তাপ তুলে নাও চুলে,
মেঘের উড়াল-দেয়া পাখিদের ফেলে যাওয়া অবিন্যস্ত ছায়া
চোখের মণিতে গাঁথো, উড়ালে বিশ্বাসী হও, পাবে।
আমাকে পাবে না প্রেমে, প্রার্থনায় নম্র হও, পাবে,
তৃপ্তির সন্ত্রাসে নয়, পিপাসায় তপ্ত হও, পাবে।
[খোন্দকার আশরাফ হোসেনের জন্ম ১৯৫০ সালের ৪ জানুয়ারি, জামালপুরের জয়নগরে। তিনি ছিলেন কবি, গদ্যকার, সাহিত্য সমালোচক, সম্পাদক, অনুবাদক এবং অধ্যাপক। তিনি ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৬৫ সালে তিনি ভাটারা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মানবিক বিভাগে মাধ্যমিক শেষ করেন। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন জামালপুরের সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজ থেকে। হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭০ সালে স্নাতক এবং পরবর্তী বছর ১৯৭১ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন ইংরেজি সাহিত্যে। পরবর্তীতে যুক্তরাজ্যের লিডস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাতত্ত্ব ও ধ্বনিতত্ত্ব বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা এবং ১৯৮১ সালে ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন।
তিনি ১৯৭৩ সাল থেকে ২০১৩ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে চার দশককাল অধ্যাপক হিসাবে কর্মরত ছিলেন। ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে অকালীন মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত তিনি ময়মনসিংহের ত্রিশালে অবস্থিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়-এর উপাচার্য হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট ও ফ্যাকাল্টি নির্বাচন কমিটির সদস্য ছিলেন।
১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে ‘ তিন রমনীর ক্বাসিদা’ শিরোনামীয় কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে বাংলা আধুনিক কবিতার জগতে তিনি আত্মপ্রকাশ করেন। খোন্দকার আশরাফ হোসেন বাংলা থেকে ইংরেজি ভাষায় এবং জার্মান ও ইংরেজি থেকে বাংলা ভাষায় অনুবাদের কাজ করেছেন। তার রচিত কবিতাও ইংরেজি, জার্মান, ফরাসি, তেলুগু এবং হিন্দি ভাষায় অনুদিত হয়েছে।
তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ত্রিশ। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: তিন রমণীর ক্বাসিদা (১৯৮৪, একবিংশ); পার্থ তোমার তীব্র তীর (১৯৮৬, মুক্তধারা); জীবনের সমান চুমুক (১৯৮৯, একবিংশ); সুন্দরী ও ঘৃণার ঘুঙুর (১৯৯২, একবিংশ); যমুনাপর্ব (১৯৯৮, প্যাপিরাস)
জন্মবাউল (২০০১, প্যাপিরাস); তোমার নামে বৃষ্টি নামে (২০০৮, চয়ন প্রকাশন); আয়(না) দেখে অন্ধ মানুষ (২০১০, নান্দনিক); নির্বাচিত কবিতা (১৯৯৫, বিশাকা); কবিতা সমগ্র (২০০৫, শিখা প্রকাশনী, ২য় সংস্করণ ২০১০, জনান্তিক)
প্রবন্ধগ্রন্থ: বাংলাদেশের কবিতা: অন্তরঙ্গ অবলোকন (বাংলা একাডেমি); চিরায়ত পুরাণ (ফ্রেন্ডস বুক কর্নার); বিশ্বকবিতার সোনালি শাশ্বত (আগামী প্রকাশনী); রোমান্টিক ও আধুনিক কবিতার অক্ষ-দ্রাঘিমা (নিউ এজ); কবিতার অন্তর্জামী (নান্দনিক); আধুনিক উত্তরাধুনিক ও অন্যান্য প্রসঙ্গ (Bangla Poetry in the contexts of Modernism, postmodernism and other trends); Modernism and Beyond: Western Influences on Bangladesh poetry (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
অনুবাদ: টেরি ঈগলটন/সাহিত্যতত্ত্ব (মূল: Terry Eagleton’s Literary Theory: An Introduction, নিউ এজ); সফোক্লিসের রাজা ঈদিপাস (মূল: Sophocles’ King Oedipus, Euripides’ Alcestis, Medea, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র); ইউরিপিডিসের আলসেস্টিস (বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র); ইউরিপিডিসের মিডিয়া (বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র); পাউল সেলানের নির্বাচিত কবিতা (জার্মান-বাংলা, বাংলা একাডেমি); ডেভিড অ্যাবারক্রম্বির সাধারণ ধ্বনিতত্ত্ব (মূল: Elements of General Phonetics by David Abercrombie, বাংলা একাডেমি); Folk Poems from Bangladesh (from Bangla into English); Folk Tales from Bangladesh (from Bangla into English);
Edith Hamilton’s Mythology (into Bangla); Oedipus Rex by Sophocles;
শিশুতোষগ্রন্থ: ওরা হারিয়ে যাচ্ছে (টইটম্বুর);
সম্পাদনা: The Dhaka University Studies (Journal of the Faculty of Arts); সম্পাদক; একবিংশ (লিটল ম্যগাজিন); সিলেকটেড পয়েমস অব নির্মলেন্দু গুণ; The Bangla Academy English-Bangla Dictionary (Co-edited, with a note on pronunciation); An English Anthology (Co-edited, published by Department of English, Dhaka University);
পুরস্কার ও স্বীকৃতি: ১৯৮৭ – আলাওল সাহিত্য পুরস্কার; ১৯৯৮ – পশ্চিমবঙ্গ লিটলম্যাগাজিন পুরস্কার; ২০০৯ – সমুজ্জ্বল সুবাতাস পদক; ২০১৩ – জীবনানন্দ পুরস্কার; ব্রক্ষ্রপুত্র সাহিত্যপদক; লিটলম্যাগ প্রাঙ্গন পুরস্কার।
খোন্দকার আশরাফ হোসেন হার্ট অ্যাট্যাক পরবর্তী চিকিৎসাকালীন সময়ে ঢাকার ল্যাবএইড হাসপাতালে ২০১৩ সালের ১৬ জুন রোববার সকালে ৬৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।