সরকার আবদুল মান্নান
কত স্মৃতির ভিতর ধুলোর আস্তর জমে। একটু ফুঁ দিলে ভেসে ওঠে স্মৃতির পর্দায়। শার্সি টেনে দেখা যায় ঝলমলে রোদের ভিতর হাসছে আনন্দ-বেদনার রোদবৃষ্টি। দুঃখ-কষ্টের জমানো ব্যথা। বেড়ে উঠবার টানটান ঘটনা। আবার মিষ্টি ফুলের সুবাসও আসে জানালার ফাঁক গলে। ড. সরকার আবদুল মান্নান নিজের জীবনের সেইসব গল্পই ধুলোর চাদর সরিয়ে পাঠকের সামনে হাজির করছেন। নিজের জীবনের সাথেও তো মিলে যায় কত কিছু!
ঢাকার গাছ সাদা কেন
মরিচা ধরা আলোটা এখন আর নেই। পুব আকাশে চাঁদ উঠার সময় ওই আলোটা ছিল। এখন আলোটা ঘোলাটে সাদা-কুয়াশার মতো, রহস্যময়। সন্ধ্যারাতের আকাশে চাঁদের এই আলো বিরাজমান থাকলে আমরা ওয়ান-টু-থ্রিতে পড়ুয়া শিশুরা ঘরে থাকি না। এ রকম বিস্ময়কর জ্যোৎস্নারাত বাইরে রেখে ঘরে বসে জ্যোৎস্না আপু পড়া মুখস্থ করছে- ‘এ্যা এ্যা এ্যা, ঢাকার গাছ সাদা কেন… ঢাকার গাছ সাদা কেন… ঢাকার গাছ সাদা কেন?’
জ্যোৎস্না আপু হাই তুলছিল আর কয়েকবার ‘ঢাকার গাছ সাদা কেন”- এই প্রশ্ন রেখে ঘুমিয়ে গেল।
আমরা তিনজন বালক অর্থাৎ আমি, হান্নান ও গফুর নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে, ঢাকা শহরের গাছ সাদা।
জ্যোৎস্না আপু এমন গুরুতর প্রশ্নের উত্তর না-জেনে কী করে ঘুমিয়ে পড়তে পারল, তা আমাদের বোধগম্য নয়। আর এখন তাকে জাগিয়ে আমরা যে এই অত্যন্ত জরুরি প্রশ্নের উত্তর জানব তাও সম্ভব নয়। সুতরাং আমরাই কারণ বের করতে চেষ্টা করলাম।
গফুর বলল, ‘সব গাছ সাদা রং করছে। বুঝলি? ওই যে আমাগ স্কুলে কে জানি আইছিল, অনেক বড় লোক… তখন গাছগুলির গোড়া সাদা রং করছিল না? ওই রহম।’
আমি বললাম, ‘সব গাছ?’
গফুর বিরক্ত হয়ে বলল, ‘রাজ্য যারা চালায়- রাজা-রানি-মন্তি- হেরা সবাই তো ঢাহা থাহে। তাইলে সব গাছ রং করব না? সোন্দর দেহানের দরকার আছে না ঢাহা শহর।’
আমি মোটেই সন্তুষ্ট হতে পারলাম না।
বললাম, ‘এত পাতা, এত পাতা! হেই পাতা ধইরা ধইরা রং করতেই তো এক মাস লাইগ্যা যাইব।’
গফুর আরও রেগে গেল।
বলল, ‘তোর মাতায় গু। ধইরা ধইরা পাতা রং করতে যাইব কোন দুঃখে! খেতে ওষুধ দেয়, দেখছস। ওই মিশিন দিয়া সাদা রং গাছে ছিটাইয়া দেয়।’
গফুরের যুক্তি আমার কাছে খুবই গ্রহণযোগ্য হলো। গফুরের প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধও বেড়ে গেল।
কিন্তু হান্না মোটেই সন্তুষ্ট নয়। গফুরের যুক্তিকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না-দিয়ে বলল,
“তুই বাহের গোত্তে কোনো দিন দেখছস, ওই মিশিন দিয়া গাছ রং করে? আমার মনে কয় কি জানস? ঢাহার মাডি সাদা। সাদা মাডিতে সাদা গাছ অয়। পাহাড়ের মাডি নাকি লাল, মইচের গুড়ার মতন। গাছও অয় লাল।’
হান্নানের কথায় আমার বিশ্বাস হলো না মোটেই। মাটি কখনো সাদা বা লাল হতে পারে না। মাটি হবে মেটে রঙের। তাই হান্নানের কথায় প্রতিবাদ করে বললাম,
“তুই কোনো দিন সাদা মাডি দেখছস? মাডি তো মাইট্টা রঙের। সাদা-লাল অইব ক্যামনে?’
কারো যুক্তিই যখন সর্বজনগ্রাহ্য হচ্ছিল না তখন আমরা বিকল্প পথ খুঁজতে লাগলাম। এর মধ্যে গফুর সব সময়ই রোমাঞ্চ, এডভ্যানঞ্চার পছন্দ করে।
গফুর বলল, ‘চল, আমরা ঢাহা যাই। ঢাহা গিয়া গাছপালাগুলি দেইখ্যা আসি।’
হান্নান ভেংচি দিয়ে বলল, ‘এহে, আয় ঢাহা যাই! ঢাহা জীবনে গেছস, চিনস বাহের গোত্তে?’
গফুর এই অপমান গায়ে মাখল না। শান্তভাবেই বলল,
“চিনি না তাতে কী? জিগাইতে জিগাইতে মক্কাও যাওন যায়। জিগাইয়া জিগাইয়া যামু গা।’
সুতরাং সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়ে গেল, আমরা ঢাকা যাব। ঢাকায় গিয়ে সচক্ষে সাদা গাছগুলো দেখে আসব। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের কারো পরামর্শ নেওয়ার সিদ্ধান্তও গৃহীত হলো। বেশ কয়েকজনের নাম করা হলো। কিন্তু নানা কারণে সবাই বাদ হয়ে গেল।
বিল্লাল কাকু! সে তো বামের বাজারেই যায় নি। সে ঢাকার শহর চিনবে কীভাবে?
ছোট কাকুর দৌড় চাঁদপুর পর্যন্ত। সে কখনই ঢাকা যায়নি।
আর কালু কাকু! গফুর বলল, ‘মতলব গেলেই সব আউল্যাইয়া ফালাইব। বাইত আইতে পারব না চিন্যা।’
“সব থিকা ভালা অইত ছত্তর কাকু।’ বলল হান্নান, ‘দুন্যাই ঘুইরা বেড়াইন্যা মানুষ। সব চিনে। কিন্তু কাকুরে পামু কই? হেয় তো থাহে বৈরব।’
শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো আমরা গোলাম হোসেন ভাইকেই জিজ্ঞাসা করব। তার কাছেই ঢাকা যাওয়ার পথঘাট চিনে নেবো।
গোলাম হোসেন ভাই থাকে বাড়ির দক্ষিণে অবস্থিত কাচারি ঘরে। যুবকদের আস্তানা এই কাচারি ঘর। পড়াশোনা করে। গল্প করে। ডাব, পেঁপে, শসা, শীতের দিনে খেঁজুরের রস এইসব চুরিদারি করে এনে খায়। এদের আড্ডাখানা হলো কাচারি ঘর। পরে বুঝেছি, ওখানে বসে অপাঠ্য বই পাঠ করা যায় এবং নিরাপদে চিঠিপত্রও লেখা যায়। অনেক কাহিনি।
আমরা তিনজন গিয়ে গোলাম হোসেন ভাইয়ের কাছে ঘুর ঘুর করতে লাগলাম। গোলাম হোসেন ভাই বলল, ‘কিরে, ঘটনা কী? কী চাস তোরা?’
গফুর বলল, ‘আচ্ছা ভাইজু, আমনে কি ঢাকা গেছেন কখনো?’
ভাইজু বলল, ‘হ গেছি। কিলিগা’?
হান্নান বলল, ‘ক্যামনে গেছেন? দূরে না অনেক?”
ভাইজু ক্যামন করে যেন হাসে। হাসতে হাসতে বলে, ‘যাবি নাকি রে ঢাহা? দূর বেশি না। পায়ে হাইট্টা যাবি এখলাসপুর লঞ্চঘাট। লঞ্চে চইড়া যাবি নারায়ণগঞ্জ। নারায়ণগঞ্জ থিকা বাসে ঢাহা। যাবি নাকি?”
আমি বললাম, ‘না ভাইজু। আমরা ঢাহা যামু ক্যামনে? ছোড মানুষ না আমরা!’
ভাইজু বলল, ‘কে কইছে তোরা ছোড মানুষ! তোরা অইলি গিয়া পাকনার হদ্দ।’
পরদিন সকালে স্কুলে যাওয়ার জন্য বই-খাতা নিয়ে বের হয়ে আমরা হাঁটা দিলাম এখলাসপুর লঞ্চঘাটের দিকে। পথে পরিচিত অনেকের সঙ্গে দেখা হলো। কোথাই যাই- এই সব জানতে চাইল কেউ কেউ। আমরা বললাম, এখলাসপুর যাবো। মামা-বাড়িতে। মামা-বাড়ির কথা শুনে কেউ আর বাধা দিল না।
ঘণ্টা দেড়েক হেঁটে আমরা তিনটি শিশু এখলাসপুর লঞ্চঘাট গিয়ে পৌঁছলাম।
জহিরাবাদ আর সানকিভাঙ্গা গ্রামের মাঝে খাল। এই খাল গিয়ে মিশেছে মেঘনায়। এই খালের একটি শাখা আমাদের বাড়ির পেছন দিক দিয়ে অনেকটা পথ ঘুরে এসে আবার আমাদের বাড়িরই দক্ষিণ দিক দিয়ে বিলের সঙ্গে মিশে গেছে। এই খালের দুই পাড়ে গ্রাম, কোথাও ফসলের মাঠ এবং কোথাওবা খেলার মাঠ। ঘন ও নির্জন জঙ্গলেরও ইয়ত্তা নেই। মাঝে মাঝে বাঁশের সাঁকো কিংবা কাঠের সাঁকো। হাঁটতে শেখার পর থেকে এই খাল, এর স্বচ্ছতোয়া জল, ঘোলা জল, কম জল, বেশি জল, এর পাড়ের এঁটেল মাটি, মাটির গন্ধ, এর দুই পাড়ে অযতেœ বেড়ে ওঠা সকল গুল্ম, বৃক্ষ, সেই গুল্ম ও বৃক্ষে বসবাস করা প্রতিটি পানকৌড়ি, মাছরাঙা, বক, চিল, কাঠঠোকরা আমাদের অত্যন্ত প্রিয়, আপনজন। তীরের কাশবনে তুলা আর নরম খরবিচালি দিয়ে আপন মনে বাসা বেঁধে চলছে যে ছোটন তার মনের কথাও যেন আমরা বুঝতে পারি। খাল লাগোয়া মাঠের একদম দক্ষিণ কোণে জারুল গাছটিতে উপনিবেশ স্থাপন করেছে ফিঙের দল। ওদের নাকি গানের গলা আছে। কিন্তু আমরা ওদের দেখি সারাক্ষণ ঝগড়া করতে। দুভাগ করা লেজ নেড়ে নেড়ে এত চিৎকার করতে পারে যে, কান জালাপালা হয়ে যাওয়ার দশা। সারাদিন কোথায় কোথায় থাকে। সন্ধ্যা হলেই এই জারুল গাছটিতে এসে জড় হবে এবং চিৎকার করে সারা দিনের গল্প একজন অন্যজনকে বলবে। কিন্তু কেউ কারো কথা শুনবে না। এদের প্রত্যেকেই আমাদের খুব পরিচিত। এমনকি যে গুইসাপটি এইমাত্র বাঁশঝাড়ের ভেতর থেকে বের হয়ে খালের তীরে বেতবনের মধ্যে হারিয়ে গেল সেও আমাদের অনেক দিনের পরিচিত।
আমাদের চিরকালের পরিচয়ের সেই সীমা অতিক্রম করে আজ আমরা শীতের কুয়াশার ভেতর দিয়ে অন্য এক জগতে এসে উপস্থিত হয়েছি। শিশিরে আমাদের পা ভিজে গিয়েছে। ভেজা পায়ে লেগে আছে সরিষার ফুল, পাপড়ি, দুর্বার ডগা, খড়বিচালি, ভিজা এটেল মাটি। সানকিভাঙ্গা ও এখলাসপুরের এই বিস্তৃত ফসলের মাঠে আমরা কোন দিকে যাচ্ছি তা বুঝতে পারছিলাম না। শুধু অনেক মানুষের পায়ে হাঁটার পথ অনুসরণ করে চলছিলাম। মাদার গাছের ডাল কেটে কেটে জমির চারদিকে কুপে রেখেছে চাষিরা। আর তার মধ্যে এক ধাপ, দুই ধাপ এবং এমনকি তিন ধাপে খড়ের রশি দিয়ে দেওয়া হয়েছে বেড়া। আল ঘুরে ঘুরে না গিয়ে কোনাকুনি যেতে পারছিনা এই বেড়াগুলোর জন্য। মাদার গাছের ডালে খুব কাঁটা। গফুরে পায়ে ওই কাঁটার আঁচর লাগে। ওর পা থেকে সামান্য রক্ত বেরোয়। খুব বিরক্ত হয়ে গফুর বলে, ‘মান্দারের ডাইলা দিয়া বেড়া দেওনের দরকার কি! হোলা দিয়া দিলেই তো অইতো।”
হাতের তালুতে দুর্বা পিষে ওর পায়ে লাগিয়ে দেয় হান্নান। রক্ত পড়াব বন্ধ হয়ে যায়। তিরিশ মিনিটের পথ পার হতে আমাদের প্রায় দুই ঘণ্টা লেগে যায়। পথে পথে যদি এত ফসল, এত ফুল, এত প্রজাপতি, এত পাখি ছড়িয়ে থাকে তা হলে আমাদের দোষ কি? খেতের চারদিকে ওই কাঁটার বেড়া দিতে বলেছে কে? এইসবের জন্যই তো আমাদের এত দেরি হয়ে গেল।
লঞ্চের জন্য অনেক লোক অপেক্ষা করছে ঘাটে। একটি লঞ্চ এসে যাত্রী নিয়ে চাঁদপুর চলে গেল। ওই লঞ্চটিতে উঠার জন্য চেষ্টা করলাম আমরা। সিঁড়ি পর্যন্ত গিয়েছিলাম। একটি বুড়ো লোক জিজ্ঞাসা করল, ‘কই যাবি তোরা?”
বলাম, ‘ঢাহা।’
“এইডা ঢাহার লঞ্চ না। ঢাহার লঞ্চ আইয়ে দহিন দিক থেকে।’ বলে লোকটি উঠে গেল লঞ্চে। আমরা দক্ষিণ দিকের লঞ্চের অপেক্ষায় পশ্চিম দিকের দূরদুরান্তে দিকবালে ম্রিয়মান গ্রামগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। গফুর বলল, ‘এক্কেবারে সাগরের লাহান। কূলকিনারা নাই।”
আমি বললাম, ‘সাগর দেখছস তুই? সাগর আরও কত্ত বড়।”
গফুর বিরক্ত হয়ে বলল, ‘কত্ত বড় সাগর কবে দেখলি তুই?”
আমিও সাগর দেখিনি। সুতরাং কথা না বাড়িয়ে চুপ করে গেলাম।
লঞ্চঘাটে এসে আমরা অভিভূত। আমাদের বাড়ির এত কাছে দিয়ে এই বিশাল জলরাশির প্রবাহ বয়ে গেছে, তা আমরা কখনই জানতাম না। অথচ কতবার নাম শুনেছি এই নদীর। মেঘনা- কত প্রিয় নাম। বিস্ময়কর মিষ্টি নাম। এত সহজ-সুন্দর নাম আর হয় না। সেই নদীর তীরে আমরা। বিস্তৃত নদীর কাছে-দূরে কত যে নৌকা- তার ইয়ত্তা নেই। সেই সব বিচিত্র নৌকায় বহু বিচিত্র রঙের পাল তোলা। বাতাস বইছে দক্ষিণ দিক থেকে। পালতোলা নৌকাগুলো চলার কথা উত্তর দিকে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, নৌকাগুলো চলছে উত্তর দিকে, পূর্ব দিকে, পশ্চিম দিকে। যেন যাদুমন্ত্রের জগৎ। ছোট-বড় জাহাজ চলছে নদীর মাঝ বরাবর। এই সব নিয়ে আমাদের তিন জনের নয় রকমের তর্কবিতর্কে সময় চলে যাচ্ছিল কোথায় দিয়ে আমরা টেরও পাইনি।
চাঁদপুর থেকে লঞ্চ এসে এখলাসপুরের এই ঘাটে যাত্রী নামিয়ে দিয়ে, যাত্রী উঠিয়ে নিয়ে চলে গেছে কয়েকবার। তার খোঁজ আমরা পাইনি। এতসব বিস্ময় যেখানে আছে সেখানে শুধু লঞ্চে উঠার তাড়া থাকে তাদেরই যাদের কোনো কাজ নেই। লঞ্চঘাটের কাছে-দূরে আমাদের অনেক কাজ। তাই ঢাকার গাছ সাদা কেন- এই রহস্য আবিষ্কারের চেয়ে এক দিক থেকে বাতাস বয় আর পাল তোলা নৌকাগুলো প্রায় সব দিকে চলে কীভাবে- সেই বিজ্ঞান বুঝতে পারা অনেক জরুরি। তার চেয়েও জরুরি বিষয় হলো, একই নদীর পানির দুই রকম রং হলো কেন? এই সব নিয়ে গবেষণা করতে করতে ঘণ্টা তিনেক অতিক্রান্ত হয়েছে।
আমাদের এই এ্যাডভেঞ্চার যাদের মোটেই পছন্দ হয় না সেই শত্রুপক্ষ বাড়িতে জানিয়ে দিয়েছে যে, ‘হান্নান মন্নান গফুর ঢাহা যাইতেছে গা।’
আমরা ঢাকা গেলে ঢাকার কী সমস্যা হবে তা বুঝতে পারলাম না। শাহজাহান ভাই, বকর ভাই আর গোলাম হোসেন ভাই এসে আমাদের বন্দি করে বাড়িতে নিয়ে গেল।
বাড়িতে নিয়ে আসার পথে উত্তম-মধ্যমসহ প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ হয়েছে। কিন্তু ঢাকা যাওয়ার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনো তথ্য পায়নি।
আমরা শুধু বললাম, ‘ঢাহা যামু কে কইছে? আমরা আইছি নদী দেখতে।’
“স্কুল কামাই দিয়া আইছ নদী দেখতে? এমন ছেচা দিমু- নদী দেখবা অনে বালা কইরা।’
শাহজাহান ভাই এরকমই বলে, মারে না। শুধুই গর্জন করে। বর্ষে না। আমরা হাসি।
বুঝতে পারলাম, হাসাটা ঠিক হয়নি। বকর ভাই আমাদের পশ্চাৎদেশে দুই ঘা বসিয়ে দিয়ে বলল, ‘হাসো, না! আমাগ তেরডা বাজাইয়া তোমরা হাসো!’
আপাতত হাসা বন্ধ হলো, কিন্তু কিছুতেই কান্না পেল না। কমপক্ষে বাড়ির কাছাকাছি এসে তো কান্না পাওয়া উচিত। মা-র সহানুভূতি লাভের জন্য। বিশেষ করে শাহজাহান বকর ও গোলাম হোসেন ভাইয়ের বিরুদ্ধে একটা কমপ্লেইন দাঁড় করার জন্য। কিন্তু কিছুতেই কান্না আসছিল না। ফলে হান্নানের মা, আমার মা ও গফুরের দাদি- এই তিন বিচারকের আদালতে তোলা মাত্র আমাদের রিমান্ড মঞ্জুর হয়ে গেল।
“ঢাহা যাইতে চাইছিল কিলিগা, জিগা।’
তিন জনের অভিন্ন সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে কাচারি ঘরে রিমান্ড শুরু হলো। অনেকক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদের পর তারা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে পারল। ঢাকার গাছ সাদা কেন জানতে আমরা ঢাকা যাচ্ছিলাম। বকর ভাই ছাড়া আর কেউ বুঝতেই পারেনি যে বিষয়টা আসলে কী?
“একদম বাইরাইয়া ঠেঙডুং ভাইঙ্গালামু। ঢাকার গাছ সাদা কে কইছে তোগ?’
আমরা সব দোষ জ্যোৎস্না আপার উপর দিয়ে দিলাম। জ্যোৎস্না আপাকে তলব করা হলো। জ্যোৎস্না আপা পরিষ্কার জানিয়ে দিল,
“কানে বেশি হোনে। আমি কইছি ঢাইক্যা রাহুন্যা গাছের কতা। গাছ ঢাইক্যা রাখলে সাদা অয়- হেই কতা কইছি। মারেন ওগো। বেশি হোনে!’
আমাদের না-মেরে হেসে ফেলল বকর ভাই। কিছুই না-বুঝে শাহজাহান ও গোলাম হোসেন ভাইও হাসতে লাগল।
বাড়িতে এবং গ্রামে রাষ্ট্র হয়ে গেল যে ঢাকার গাছ সাদা কেন- এই রহস্য উন্মোচনের জন্য আমরা ঢাকা যাচ্ছিলাম। আমাদের মতো অনেকেই তখন ভাবনায় পড়ে গেল। ঢাকার গাছ সাদা?
মা বলল, ‘ঢাকার গাছ সাদা, না কালা, এইডা দিয়া তোর দরকার কী? তোগ অইল পড়া দিয়া কাম। আর যদি এমন কুবুদ্ধি মাতায় আইয়ে, হুইন্যা রাহিস, একদম মাইরালামু।’
এই বলে মা ভাত খেতে দিল।
বিকালে আবার আমাদের তিন জনের ডাক পড়ল কাচারি ঘরে। গাছ ঢেকে রাখলে কেন সাদা হয়- এই বিজ্ঞানটা আমাদের বুঝি দল বকর ভাই।
আমরা ছোট চাচির লাগানো সিমের চারার উপর মাটির একটি হাড়ি বসিয়ে দিলাম। দু-এক বার উলটিয়ে দেখেও এলাম এবং এরপর ভুলে গেলাম।
সপ্তাখানেক পরে চাচি চিৎকার করে বলছিল, ‘হায় হায়, আমার এই সর্বনাশ কে করল রে। সিমের চারা গুলাইন সাদা অইয়া মইরা গেল।’
আমি হান্নান গফুর এবং আরও অনেকে দেখলাম, সিমের চারাগুলো সাদা হয়ে গেছে। বকর ভাই আমাদের ডেকে এনে অতি গোপনে জিজ্ঞাসা করল, ‘কি রে! তোরা পরীক্ষা করছস?’
আমরা বললাম, ‘হ!’
“ফল পাইছস?’
বললাম, ‘পাইছি।’
বকর ভাই বলল, ‘ঠিক আছে। আর কাউরে কবি না। কইলে ছোট চাচি মাইরা আস্ত রাখব না।”
সেই দিন থেকে বকর ভাইকে আমারা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী বলে মনে করতে লাগলাম।
[চলবে]