আড্ডাপত্র

৬ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১; ২১ নভেম্বর, ২০২৪;বিকাল ৩:২৭

সরদার ফজলুল করিম এর সাড়া জাগানো ‘দর্শনকোষ’ || পর্ব- ৩

আড্ডাপত্র

নভে ২৬, ২০২০ | দর্শনতত্ত্ব

[সরদার ফজলুল করিম এর সাড়াজাগানো ‘দর্শনকোষ’ প্রথমে বাংলা একাডেমী পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় ১৯৬৮ সালে। পর্ববর্তীতে বাংলা একাডেমী গ্রন্থাকারে বের করে ‘দর্শনকোষ’। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। ১৯৭৩, ৮৬ ও ৯৫ সালে বের হয় তিনটি সংস্করণ। এরপর অন্যান্য প্রকাশনী থেকেও ‘দর্শনকোষ’ বের হয়। গত অর্ধশতাব্দীকাল ধরে ‘দর্শনকোষ’ এর গুরুত্ব এতটুকু কমেনি। বরং এর পাঠক সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। পাঠকের চিন্তাকে নাড়া দিতে দার্শনিক সরদার ফজলুল করিম এর অবদান অপরিসীম। তাঁর দর্শনকোষ আড্ডাপত্র’র পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হচ্ছে ধারাবাহিকভাবে]

Agrippa: আগারিপা (খ্রি. দ্বিতীয় শতক )

খ্রিষ্টাব্দের আনুমানিক দ্বিতীয় শতকের রোমান সংশয়বাদী দার্শনিক। কেউ কেউ আগরিপাকে গ্রিক দার্শনিক বলেও মনে করেন। প্রাচীন সন্দেহবাদীদের মধ্যে আগরিপা অবশ্যই বিশিষ্ট ছিলেন। কারণ প্রাচীন যুগে ‘আগরিপা’ নামে একখানা পুস্তক রচিত হওয়ার কথা জানা যায়।
আগরিপা জ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁর ‘পঞ্চ’ যুক্তির জন্য খ্যাতি অর্জন করেন। সংশয়বাদী এনিসিডেমাসের সমস্যা ছিলো দশটি। আগরিপার সমস্যার মূলগতভাবে এনিসিডেমাসের সমস্যা থেকে পৃথক না হলেও আগরিপার সমস্যার ব্যাপকতা এনিসিডেমাসের চাইতে অধিক। জ্ঞানের কোনো নিশ্চয়তা নাই-এ অভিমত আগরিপা তাঁর পঞ্চযুক্তির মারফত যত জোরালোভাবে উপস্থিত করেছিলেন, প্রাচীন দর্শনে সেরূপ জোরালো অভিমত অপর কোনো সংশয়বাদী উপস্থিত করেন নি।
জ্ঞানের অনিশ্চয়তার প্রমাণস্বরূপ আগরিপার পঞ্চযুক্তি নিন্মরূপ:
প্রথম যুক্তি পরস্পর-বিরোধীতা। বস্তুজগৎ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান পরস্পর-বিরোধী। সাধারণ মানুষ এবং দার্শনিক এরা কেউ জ্ঞানের মাধ্যম সম্পর্কে ঐকমত্য পোষণ করেন না। কোনো পক্ষের মতে ইন্দ্রীয়দত্ত জ্ঞানই জ্ঞান। আবার অপর কোনোপক্ষ এরূপ অভিমত পোষণ করে যে ইন্দ্রীয় এবং অনুভূতি উভয়ের মাধ্যমে আমরা জ্ঞান লাভ করি। পরস্পর-বিরোধী এই অভিমতের কোনো মীমাংসা নাই। ফলে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
দ্বিতীয় যুক্তি বিরামহীন পশ্চাদ্ধবনের যুক্তি। জ্ঞানের ক্ষেত্রে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য আমরা একটি দত্ত সত্য বা প্রতিজ্ঞার উপর নির্ভর করি। একটি বিশেষ অনুমানের ক্ষেত্রে দত্ত সত্যকে সঠিক বলে ধারণা করি। কিন্তু সঠিক বলে গৃহীত সত্যেরও প্রমাণের আবশ্যক। সেরূপ প্রমাণের জন্য অপর একটি দত্ত সত্য বা প্রতিজ্ঞার উল্লেখ করি। কিন্তু এর প্রমাণের জন্য অপর আর একটি সত্যের আমরা বরাত দেই। বরাতের পরে এই বরাতের এই ধারা বিরামহীন। ফলে চুড়ান্তরূপে কোনো সিদ্ধান্তে পৌছান আমাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। স্বতঃসিদ্ধের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা। যাকে স্বতঃসিদ্ধ বলে গ্রহণ করা হয়, তা যে স্বতঃসিদ্ধ-তারও প্রমাণ আবশ্যক। কিন্তু প্রমাণ শুরু করলেই আমরা বিরামহীন বরাতের অন্তহীন পশ্চাদ্ধাবনের পক্রিয়ায় জড়িত হয়ে পড়ি। ফলত জ্ঞান এ-ক্ষেত্রে অসম্ভব।
তৃতীয় যুক্তি: আপেক্ষিকতা। বিষয়ী বা যে জানে তার সঙ্গে বিষয় বা জানা হয় তার সম্পর্ক অর্থ্যাৎ বিষয়ের সঙ্গে বিষয়ীর সম্পর্ক জ্ঞানকে গঠিত করে। ফলে এই সম্পর্ক-বহির্ভূত অবস্থায় জ্ঞাত বিষয়ের চরিত্র কি তার জ্ঞানলাভ আমাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে।
চতুর্থ চুক্তি: হাইপথেসিস বা প্রকল্প। কোনো সিদ্ধান্তের জন্য সিদ্ধান্তের চেয়ে অধিকতর ব্যাপর একটি বিবৃতিকে আমরা সত্য বলে গ্রহণ করি। একে আমার হাইপথেসিস বা প্রকল্প বলি। গৃহীত সিদ্ধান্তের সত্যাসত্যকে আমরা স্বীকৃত প্রকল্পের সঙ্গে সঙ্গতি-অসঙ্গতির ভিত্তিতে প্রমাণ করি। কিন্তু সে প্রকল্পের ভিত্তিতে আমরা একটি বিশেষ সিদ্ধান্ত প্রমাণ করি, সেই প্রকল্পের প্রমাণের কোনো প্রশ্ন আমরা উত্থাপন করি নে; ফলে অপ্রমাণিতের ভিত্তিতে প্রমাণের অসঙ্গতি সৃষ্ট হয়।
পঞ্চম যুক্তি: চক্রাবর্তের সমস্যা। অনেক ক্ষত্রে স্বীকৃত প্রতিজ্ঞার প্রমাণের জন্য আমরা সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করি। এতে সিদ্ধান্তের প্রমাণের জন্য প্রতিজ্ঞা এবং প্রতিজ্ঞার প্রমাণের জন্য সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করার চক্রাবর্তের সৃষ্টি হয়; ফলে কোনোটি সম্পর্কেই আমরা কোনো জ্ঞানলাভ করতে সক্ষম হই ন। চক্রাবর্তের দৃষ্টান্ত হিসাবে এই যুক্তিটির উল্লেখ করা যায়: মানুষ মরণশীল। সক্রেটিস একজন ভালো মানুষ। সুতরাং সক্রেটিস মরণশীল। পুনরায় সক্রেটিস মরণশীল। সক্রেটিস একজন মানুষ। সুতরাং সকল মানুষ মরণশীল।
আগারিপার পঞ্চযুক্তির সবগুলো হয়তো তাঁর নিজের মৌলিক কোনো উপস্থাপনা নয়। আগারিপার পূর্বগামী সংশয়বাদী দার্শনিকগণ নানাভাবে জ্ঞানের অনিশ্চয়তার প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন। কিন্তু আগরিপার বেশিষ্ট্য এই যে, তিনি জ্ঞানের প্রশ্ন সংশয়কে যেরূপ স্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্টভাবে প্রকাশ করেছেন, এরূপ সুনির্দিষ্ট প্রকাশ প্রাচীন সংশয়বাদের ইতিহাসে অপর কোনো দার্শনিকের মধ্যে দেখা যায় না।

Aggression: অন্যায় আক্রমণ, আগ্রাসন

একটি রাষ্ট্র অপর রাষ্ট্রের উপর বিনা কারণে সশস্ত্র আঘাত হানলে তাকে আক্রমণ বা আগ্রসন বলা হয়। অন্যায় আক্রমণ কথাটির অর্থ সহজ হলেও যুদ্ধমান পক্ষের কেউই আক্রমণকারী বলে চিহ্নিত করতে চায় না। পরস্পর পরস্পরকে আক্রমণকারী বলে অভিযুক্ত করে। একমাত্র নিরপেক্ষ কারুর পক্ষে বলা সম্ভব যে, এমন ক্ষেত্রে আক্রমণকারী কে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ শুরু হলে তখন আর কেউ নিরপেক্ষ থাকে না। কেবল বিশ্বযুদ্ধ নয়। আধুনিক আন্তর্জাতিক জটিল রাজনীতিতেও নিরপেক্ষ কোনো রাষ্ট্র আছে, একথা বলা কঠিন। কোনো অবস্থায় কোনো কার্য আক্রমণ বলে বিবেচিত হবে এর কোনো সংজ্ঞা জাতিসংঘের ঘোষণাপত্রেও গৃহীত হয় নি। ১৯৩৩ সালে আক্রমণের সংজ্ঞা নির্ধারণের জন্য আফগানিস্তান, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, ইরান. পোলাণ্ড, রুমানিয়া, তুরস্ক এবং রাশিয়া এই আটটি দেশের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনে এরূপ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল যে (ক) এক রাষ্ট্র কর্তৃক অপর রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা (খ) যুদ্ধ ঘোষণা ব্যাতিরেকে আক্রমণ (গ) যুদ্ধ ঘোষণা ব্যতীত অপর রাষ্ট্রের ভূখণ্ড, নৌযান বা বিমানের উপর সশস্ত্র আক্রমণ (ঘ) এক রাষ্ট্র কর্তৃক অপর কোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নৌঅবরোধ সৃষ্টি এবং (ঙ) প্রতিপক্ষীয় রাষ্ট্রের বিদ্রোহত্মক কোনো সশস্ত্র বাহিনীকে আশ্রয় দান কিংবা তাকে সশস্ত্রভাবে সজ্জিত করতে সাহায্য করা এবং প্রতিপক্ষীয় রাষ্ট্রের দাবি সত্ত্বেও এরূপ বাহিনীকে বহিষ্কার করে দিতে অস্বীকার করাকে একের বিরুদ্ধে অপরের আক্রমণ বলে বিবেচিত হবে।

Ajivika: আজীবিক

শব্দগত অর্থ আজীব আ +জীব+অ জীবনসাধন, জীবনোপায় জীবিকা। খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম এবং ষষ্ঠ শতাব্দিতে ভারতবর্ষে বৌদ্ধ এবং জৈনধর্মের প্রচারের সমকালে ‘আজীবিক’ নামক একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। এই সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ‘গোশাল’ বলে এক ব্যক্তি। গোশালে জন্ম বলেই তাঁর নাম গোশাল হয়েছিল এরূপ অনেকে মনে করেন। জীবন, ধর্ম, দেহ, আত্মা, বিশ্ব ইত্যাদি সমস্যা সম্পর্কে আজীবিক সম্প্রদায়ের অভিমত আজীবিকবাদ বলে প্রাচীন ভারতীয় দর্শন শাস্ত্রের ইতিহাসে আখ্যাত হয়েছে।
প্রাচীণ ভারতীয় দর্শনে আজীবিকদের তত্ত্বের একটি গুরুত্ব আছে। এঁরা জীরন ও জগতের ব্যাখ্যায় আত্মার অস্তিত্ব অস্বীকার করেছিলেন। এঁদেরকে অনুবাদী বলেও আখ্যঅয়িত করা হয়। আজীবিকদের মতে, বস্তু জগতের মূলে রয়েছে চারটি মৌলিক অণু, যথা- মৃত্তিকা, পানি, অগ্নি এবং বায়ু। জগতের যা কিছু সৃষ্টি তার এই চারটি মূল অণুর সম্মেলনেই গঠিত হয়। জীবন নিজে অণু নয়। জীবন এমন একটি শক্তি যার অণুর সম্মেলনকে অনুধাবন করতে সক্ষম। সৃষ্টির মৌলিক পদার্থ অণু শাশ্বত। অণুর বিভাজন নেই। অণু সৃষ্টির মূলে। কিন্তু নিজে সৃষ্ট নয়। অণুর ধ্বংসও সম্ভব নয়। মৌলিক অণুগুলি গতি নয়। এক অণু অন্য অণুতে রূপান্তরিত হতে পারে না। কিন্তু যে কোনো অণু যে কোনো অভিমুখে গতিশীল হতে পারে। বস্তুর যে গুণ তা একটি বিশেষ বস্তুর অণুর সংখ্যা এবং সম্মেলন প্রকারের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট হয়। জীবন ও জগতের এই বিশ্লষেণ তেকে বুঝা যায়, আজীবিকগণ প্রাচীন ভারতীয় দর্শনে বস্তুবাদী মত পোষণ করতেন। সম্ভবত ইতিহাসে এঁরাই প্রথম অনুবাদী। আজীবিকদের অনুবাদী মতের সঙ্গে প্রাচীন গ্রিসের ডিমোক্রিটাস (খ্রি. পূ. ৪৬০-৩৭০) এবং এপিক্যুরাস (খ্রি. পূ. ৩৪১-২৭০) এর অনুবাদী তত্ত্বের বেশ সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। আজীবিকদের প্রতিষ্ঠাতা গোশাল সম্পর্কে এরূপ কথিত আছে যে, তিনি জৈনধর্মের প্রতিষ্ঠাতা মহাবীরের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। গোশাল জৈনধর্মের জন্মের প্রকারভেদ অস্বীকার করেন। তাঁর মতে জীবন মাত্রই, নিয়তির বন্ধনে আবদ্ধ। জন্মের কোনো প্রকারভেদ বা জন্মান্তরের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি কর্মের বন্ধন থেকে মুক্তি বা নির্বাণ লাভ করতে পারে, এ কথা গোশাল মানতেন না। গোশালের মতে জন্মান্তরের দীর্ঘ কিংবা হ্রস্ব কোনো সড়কেই জীবনের দুঃখ বা কর্মের বন্ধন থেকে মানুষের মুক্তির উপায় নেই। মানুষের জীবনের পথ পূর্ব থেকেই নির্ধারিত। কোনো সাধনা বা আচরণই জীবনের সেই নির্ধারিত পথকে পরিবর্তিত করতে পারে না।
গোশাল এবং আজীবিকগণ জীবনোপায় বা জীবনাচরণে সাধারণের ব্যতিক্রম ছিলেন। তাঁরা দিগম্বর থাকতেন এবং একটি দণ্ড হাতে চলতেন। এজন্য এঁদের ‘দণ্ডী’ও বলা হতো। এঁরা ভিক্ষা করে জীবন ধারণ করতেন। কিন্তু ভিক্ষা করেও প্রয়োজনের অধিক জমাতেন না।
সম্রাট অশোকের শাসনকাল ছিল খ্রি. পূ. ২৭৪-২৩২ সন। সম্রাট অশোকের নানা অনুশাসন প্রস্তর খণ্ডে উৎকীর্ণ করা হয়েছিল। এরূপ একটি প্রস্তরলিপিতে আজীবিক সম্প্রদায়ের উল্লেখ দেখা যায়। এই লিপিতে বলা হয়েছে যে, সম্রাটের এরূপ কর্মচারী বা মহামাত্রও নিযুক্ত রয়েছে যাদের দ্বায়িত্ব হচ্ছে আজীবিকদের বিষয়ে তত্ত্বাবধান করা।

Al-Farabi: আল – ফারাবী (৮৭৩-৯৫০ খ্রি.)

আল –ফারাবীর সম্পুর্ণ নাম হচ্ছে আবু নসর মুহাম্মদ আল -ফারাবী। দর্শনের ইতিহাসে ইনি আল –ফারাবী নামেই সুবিখ্যাত। ইসলামি দর্শনে আল –ফারাবীকে সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনি বলে মনে করা হয়। মুসলিম দার্শনিকগন মনে করতেন, আল –ফারাবীর শ্রেষ্ঠ যদি কেউ থাকেন তিনি হচ্ছেন গ্রিক দার্শনিক এ্যারিস্টটল। মুসলিম দার্শনিক আলকিন্দী আল -ফারাবীকে নিঃসন্দেহে ইবনে সীনা এবং ইবনে রুশদ-এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে স্বীকার করেছেন।
ক্রিষ্টাব্দের নবম এবং দশম শতকে মুসলিম রাষ্ট্রসমূহে, বিশেষ করে বাগদাদে গ্রিক দর্শনের বিশেষ চর্চা হতো। এই সময়ে গ্রিসের প্লেটো এবং এ্যারিস্টটলের রচনাবলীর আরবি অনুবাদ হতে থাকে। আল –ফারাবী প্রধানত শিক্ষালাভ করেন বাগদাদের এ্যারিস্টটল-এর দর্শন শিক্ষাদানকারী খ্রিষ্টান বিদ্যাকেন্দ্রে। প্লেটোর দর্শনের নতুনতর ব্যাখ্যাদাতা প্লাটিনাস-এর ব্যাখ্যার প্রভাবও আল –ফারাবীকে এত প্রভাবিত করেছিল যে, উপরোক্ত দর্শনের এই দুই স্তম্ভ আল –ফারাবী কাউকে বর্জন করতে পারেন নি। এ কারণে আল –ফারাবী প্লেটো এবং এ্যারিস্টটলের সামঞ্জস্যের বিষয়ে একখানি পুস্তক রচনা করেন। আল –ফারাবী শিক্ষাগত জীবনে কেবল দর্শনের চর্চা করেন নি। তিনি সে-যুগের জ্ঞানের অন্যান্য শাখাও আয়ত্ব করার চেষ্টা করেন। পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা এবং সঙ্গীতের বিচিত্র শাখাতে তিনি পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন।
আল –ফারাবী প্লেটোর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘রিপাবলিক’ এবং ‘লজ’ বা ‘বিধান’-এর উপর নিজের অভিমত লিপিবদ্ধ করেন। আল –ফারাবীর সমধিক বিখ্যাত গ্রন্থের নাম হচ্ছে ‘উত্তম রাষ্ট্রের অধিবাসীদের ভ্রান্তি সম্পর্কিত গ্রন্থ’। এ গ্রন্থ আদর্শ নগর বা ‘মদিনাল ফাজিলা’ বলেও আখ্যাত। গ্রন্থের নামকরণ এবং বিষয়বস্তু থেকে বুঝা যায়, প্লেটো যেমন ‘রিপাবলিক’ বা আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনা করেছিলেন, আল -ফারাবীও তেমন একটি আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনা করেছিলেন। আল -ফারাবীর আদর্শ রাষ্ট্র প্লেটোর রাষ্ট্রের ন্যায় সাধারণ মানুষের অসাধ্য বোধ হতো না। প্রকৃত পক্ষে আল –ফারাবী যে সমস্ত মুসলিম রাষ্ট্রকে কার্যকর দেখেছে, তাদের উন্নত করার উদ্দেশ্য নিয়ে নিজের আদর্শ রাষ্ট্র কল্পনা করেছিলেন। আল –ফারাবী কোনো চরম মত পোষণ করেন নি। চিন্তার ক্ষেত্রে প্রায়ই তিনি পরস্পর-বিরোধী ধারাকে এক সাথে মিলাবার চেষ্টা করেছেন। এই আপসের প্রমাণ যেমন প্লেটো এবং এ্যারিস্টটলকে ঐক্যবদ্ধ করার মধ্যে রয়েছে, তেমনি বিশ্বের স্রষ্টা এবং সৃষ্টির ব্যাখ্যাতেও রয়েছে। আল –ফারাবী একদিকে মনে করেছেন যে, আল্লাহই হচ্ছেন একমাত্র স্রষ্টা; আর সমস্ত সৃষ্টি আল্লাহর প্রকাশ। অপর দিকে আল্লাহকে স্রষ্টা স্বীকার করেও সৃষ্টি বা বিশ্বকে শাশ্বত বলে তিনি অভিমত পোষণ করেছেন। বিশ্বকে শাশ্বত মনে করার মধ্যে বস্তুজগৎ এবং বিজ্ঞানকে স্বীকারের প্রবণতা আল –ফারাবীর চরিত্রে দেখা যায়। এদিক থেকে সে-যুগে তিনি প্রগতিশীল চিন্তাবিদের স্বাক্ষর রেখেছেন, একথা বলা যায়। ধর্মের ন্যায় তাঁর রাষ্ট্র-ব্যবস্থাতেও একনায়কত্বের প্রকাশ ছিল। আল –ফারাবীর মতে রাষ্ট্রের রইস বা প্রধান থাকবে সবার উপরে। অপর সকলে তার বাধ্য হবে। সে নিজে কারু বাধ্য হবে না। নাগরিকদের মধ্যে ক্ষমতা ভাগের ক্ষেত্র স্তরভেদ থাকবে। এক স্তর তার উপরের স্তরের আদেশ মান্য করবে। এবং অধঃস্তরের উপর আদেশ জারি করবে। অধঃতম স্তরের নাগরিক কেবল হুকুম মান্যই করবে অপর কাউকে সে হুকুম দিবে না। কারণ হুকুম দেবার মতো তার নিচে অধঃতর কোনো স্তর থাকবে না। মুসলিম সভ্যতার অর্থনীতিক বিকাশের তৎকালীন যুগে একনায়কতন্ত্রের এই ধারণা গোত্রতান্ত্রিক বহুধাবিভক্ত সামন্তবাদী সমাজকে এককেন্দ্রিক বৃহত্তর রাষ্ট্র-কাঠামোর মধ্যে সংহত করার অনুকূল শক্তি হিসাবে কাজ করেছে। যুগের প্রেক্ষিতে এরূপ ভাবধারার বিশেষ গুরুত্ব ছিল। চরম সত্য বা স্রষ্টার ব্যাখ্যায় আল –ফারাবী যেমন প্লেটোর ভাবধারাকে গ্রহণ করেছেন, মনোজগতের বিশ্লেষণে তেমনি তিনি এ্যারিস্টটল-এর ব্যাখ্যাকেই অধিকতর স্বীকার করেছেন।
আল –ফারাবীর রচনাসমূহ জার্মান এবং ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়ে বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে।

Alberuni: আলবেরুণী (৯৭৩-১০৫০ খ্রি.)

পৃথিবীরঅন্যতম শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক, বিজ্ঞানী, গবেষক এবং জ্ঞানসাধক। জন্ম মদ্য এশিয়ার (রাশিয়ার) খোরেজাম বা খারিজমের খিবায় ৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে। মৃত্যু ১০৪৮ কিংবা ১০৫০ খ্রিষ্টাব্দে।
‘আলবেরুণী’ নামে ইতিহাসে পরিচিত। আসল নাম আবু রায়হান মুহম্মদ বনি আহমদ । তাঁর সমসাময়িকদের মধ্য ছিলেন বোখারার বিখ্যাত দার্শনিক ইবনে সিনা (৮৯০-১০৩৭ খ্রি.)। জন্মসূত্রে আলবেরুণী পারসিক এবং শিয়া ছিলেন। ‘তাঁর সমালোচনার ক্ষমতা, সহনশীলতা, সত্যানুরাগ এবং মানসিক সাহস মধ্যযুগে অতুলনীয় ছিল। তিনি আরবি ভাষায় ভূগোল, গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কে বহু গ্রন্থ রচনা করেন।’ গবেষকগণ তাঁর রচনার সংখ্যাকে বিপুল বলে অনুমান করেন। “১০৩৫ খ্রিষ্টাব্দে এক বন্ধুর জিজ্ঞাসার জবাবে লেখা আল-বেরুণীর একটি চিঠির নকল পাওয়া গেছে যাতে তিনি তখন পর্যন্ত তাঁর লিখিত পুস্তক-পুস্তিকার একটি ফিরিস্তি দিয়েছিলেন। তালিকা মতে ১৩৮ টি পুস্তকের নাম আছে। এ তালিকা তৈরির পরেও তিনি প্রায় সতের বৎসর জীবিত ছিলেন। পরবর্তী সতের বৎসর ধরে তিনি আরো যেসব বই লিখেছিলেন তা ধরলে এবং অন্যান্য সাহিত্য গ্রন্থপঞ্জিতে যেসব বই-এর নাম পাওয়া যায় সেসব মিলিয়ে বর্তমান পণ্ডিতরা আলবেরুণীর রচিত ১৮০ টি পুস্তকের নাম পেয়েছেন। আলবেরুণীর গ্রন্থাবলী ১২ শতক থেকে ইউরোপে যতটা আদৃত হয়েছে, প্রাচ্যে ততটা হয় নি।”
বাংলাদেশে সাহিত্যিক সত্যেন সনে আলবেরুণীর ভারত আগমন এবং তাঁর জ্ঞান সাধনাকে ভিত্তি করে ‘আলবেরুণী’ নামক ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনা করেছেন (১৯৬৯)। মধ্যযুগের ভারতবর্ষের সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনের ইতিহাসের অতুলনীয় উপাদান হিসাবে আলবেরুণীর ‘ভারততত্ত্ব’ পৃথিবীতে আজ সুপরিচিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ঐতিহাসিক আবু মহামেদ হবিল্লাহ আলবেরুণীর ‘ভারততত্ত্ব’ গ্রন্থটি মূল আরবি থেকে বাংলাতে অনুবাদ করেছেন (১৯৭৪)।

আলবেরুণীর ‘ভারততত্ত্ব’ গ্রন্থের মূল আরবি নাম ‘কিতাব কি তাহকিক মালিল হিন্দ মাকুলাত মাকবুলাত কি আল আকল উমর যুলাত।’ বাংলঅ গদ্যে এর মানে : বুদ্ধি বিচারে যা গ্রহনযোগ্য আর যা গ্রহনযোগ্য নয়, হিন্দুদের সব রকম চিন্তা পদ্ধতির সঠিক বর্ণনা।
Book on an accurate description of all catagories of Hindu thought, those which are admissible to reason as well as those which are not. এডওয়ার্ড জাকাউ (Edward Zachau) কর্তৃক সম্পাদিত মূল আরবি গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৮৮৭ সালে লণ্ডন থেকে। Alberuni’s India- এই নামে দুখণ্ডে এর ইংরেজি অনুবাদ এডওয়ার্ড জাকাউ প্রকাশ করেন ১৮৮৮। কিতাবুল হিন্দ নামেও আলবেরুণীর ‘ভারততত্ত্ব’ পরিচিত।

গজনীর সুলতান মাহমুদ ভারত আক্রমণ করে তার উত্তর পশ্চিম দখল করছিলেন (১০২২ খ্রি.)। সুলতান মাহমুদ মধ্য এশিয়ার ক্ষূদ্র খারিজাম রাষ্ট্রও জয় করেছিলন। খারিজাম জয় করে সেখানকার গণ্যমান্য নাগরিক এবং জ্ঞানীদের তিনি তাঁর রাজ্য গজনীতে বন্দি করে এনেছিলেন (১০১৭ খ্রি.)। এই বন্দিদের মধ্যে খারিজামের আলবেরুণী ছিলেন। পরবর্তীকালে সুলতান মাহমুদ কর্তৃক হয়তো আলবেরুণীই ভারতের পশ্চিম অঞ্চলে প্রেরিত হয়েছিলেন। জ্ঞানসাধক আলবেরুণী তাঁর এই ভারত গমনকে ভারতের সামাজিক ও ধর্মীয় জীবন সাক্ষাৎভাবে অধ্যয়নের বিরাট সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। ভারতবর্ষে থাকাকালীন সময়ে তিনি ভারতীয় সমাজের তথ্যাবলী গভীর অভিনিবেশ এবং আগ্রহের সঙ্গে সংগ্রহ করেছিলেন। এই সংগ্রহ এবং পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে আলবেরুণী ‘কিতাবুল হিন্দ্’ রচনা সমাপ্ত করেন ১০৩৩ খ্রিষ্টাব্দে গজনী প্রত্যাবর্তন এবং সুলতান মাহমুদের মৃত্যুর পাঁচমাস পরে।

কিতাবুল হিন্দ্ বা ভারততত্ত্বে আলবেরুণী জটিল এবং বিচিত্র তত্ত্ব এবং তথ্য যেরূপ বিস্তারিতভাবে প্রাঞ্জল ভাষায় উপস্থিত করেছেন তা এক বিষ্ময়কর শক্তির ষ্মারক হিসাবে জ্ঞানের ইতিহাসে বিরাজ করছে। ‘কিতাবুল হিন্দ্’ রচনার পূর্বে আলবেরুণী কপিলের সাংখ্য এবং পাতঞ্জল দর্শনসহ পৌলিশ সিদ্ধান্ত, ব্রহ্ম সিদ্ধান্ত, বৃহৎসংহিতা, খণ্ডখাদ্যক, বরাহমিহিরের লঘুজাত কর্ম প্রভৃতি ছোটবড় ২২ টি ভারতীয় পুস্তক আরবিতে তর্জমা করেছিলেন। তিনি বহু ভাষাবিদ ছিলেন। ভারতীয় সংস্কৃত গ্রন্থের আরবি অনুবাদ থেকে বুঝা যায়, তিনি সংস্কৃত ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন। তা ছাড়া ফার্সি, গ্রিক, হিব্রু এবং আরামিয় ভাষাতেও তিনি সুপণ্ডিত ছিলেন। আলবেরুণীর মাতৃভাষা ছিল খোরেজামী বা প্রাচীন ইরানি ভাষার একটি আঞ্চলিক শাখা। কিন্তু তাঁর বেশিরভাগ গ্রন্থ আরবি ভাষাতেই রচিত। কারণ তাঁর মাতৃভাষাকে তিনি বৈজ্ঞানিক ভাব প্রকাশের উপযোগী মনে করেন নি।

অধ্যাপক মহামেদ হবিবুল্লাহ বাংলা অনুবাদে দেখা যায় আলবেরুণীর ‘ভারততত্ত্ব’ প্রস্তাবনা ব্যতীত আশিটি অধ্যায়ে বিভক্ত। আলোচিত বিষয়ের আভাসদানের জন্যে কিছুসংখ্যক অধ্যায়ের শিরোনাম এখানে উল্লেখ করা গেল: ভারতীয়দের সাধারণ বৈশিষ্ট্য; ঈশ্বর সম্বন্ধে হিন্দুদের বিশ্বাস; ভাব এবং ইন্দ্রিয় জগৎ সম্পর্কে হিন্দুদের ধারণা; কার্যকরণ- আত্মার সঙ্গে জড় পদার্থের সম্বন্ধ;সৃষ্ট জীবসমূহের শ্রেণীবিভাগ ও তাদের নাম; মূর্তি পূজার সূচনা ও বিগ্রহসমূহের বর্ণনা; হিন্দুদের ব্যকরণ ও ছন্দশাস্ত্র; ভারতীয় পরিমাণ বিজ্ঞান; ভারতীয়দের বর্ণমালা, বর্ণচিহ্ন ও অদ্ভুত রীতি; ভারতবর্ষের নদ-নদী; সমুদ্র নাগরাদির পারস্পারিক দূরুত্ব ও সীমানার সংক্ষিপ্ত বিবরণ; গ্রহ নক্ষত্রাদির নাম, চন্দ্রের কক্ষপথ ও অনুরূপ বিষয়; মেরু পর্বতের কথা; সমুদ্রে জোয়ার ভাটার পারস্পর; সূর্য-চন্দ্রের গ্রহণ; আদালতের মামলা মোকদ্দমা।
মোটকথা, এ এক অতুলনীয় গ্রন্থ। এ গ্রন্থ দশম-একাদশ শতকের ভারতীয় জ্ঞান, সমাজ, ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার আচরণের একটি পূর্ণ জ্ঞান কোষবিশেষ।

আলবেরুণী রচিত অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ইতিহাসের কাল নিরুপণের পদ্ধতি বিষয়ক ‘আসারূল বাকিয়া’; গণিতশাস্ত্র ও জ্যামিতি বিষয়ক গ্রন্থ ‘কিতাব কানুন আল মাসুদী কি হাইওআল নজুম’; ধাতুবিদ্যা বিষয়ক ‘কিতাবুল জামাহীর ফি মারেফাতুল জওয়াহীর’; চিকিৎসা শাস্ত্র বিষয়ক ‘কিতাব আল সায়দানা ফিল তিব্ব্’; এবং ভৌগলিক তথ্যমূলক গ্রন্থ ‘তাহদীদ ফি নেহায়াতুল আমাকিন’।
তাঁর রচনায় বিষয়ভিত্তিক সংখ্যা আলবেরুনীর নিজের প্রস্তুত একটি তালিকার ভিত্তিতে নিন্মরূপ : জ্যোতিষ পদ্ধতি ও জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে ১৮; বিভিন্ন দেশের ভৌগোলিক তথ্য, আয়তন , দূরত্ব নির্ণয় ইত্যাদি-১৫; গণিত পদ্ধতি-৮; সূর্যকিরণ ও ছায়ায় বৈজ্ঞানিক তথ্য-৪; জ্যোতির্বিজ্ঞানের যন্ত্রপাতি নির্মাণ বিষয়ে-৫; কাল ও সময় নির্ণয়-৫; জ্যোতিশাস্ত্রে শুভাশুভ ফলাফল নির্ণয়-১২; জ্যোতিষ গণনাবিধি-৭; উপন্যাস, কাব্য ও অতিপ্রাকৃত কিংবদন্তি বিষয়ক-১৩; ধর্ম বিশ্বাস ও আচরণ বিষয়ে -৬।
(দ্রষ্টব্য: আলবেরুণীর ভারততত্ব: আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ; আলবেরুণী: সত্যেন সেন।)

Facebook Comments

আড্ডাপত্রে লাইক দিন

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১১৩১৫১৬
১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭৩০