সরকার আবদুল মান্নান
কত স্মৃতির ভিতর ধুলোর আস্তর জমে। একটু ফুঁ দিলে ভেসে ওঠে স্মৃতির পর্দায়। শার্সি টেনে দেখা যায় ঝলমলে রোদের ভিতর হাসছে আনন্দ-বেদনার রোদবৃষ্টি। দুঃখ-কষ্টের জমানো ব্যথা। বেড়ে উঠবার টানটান ঘটনা। আবার মিষ্টি ফুলের সুবাসও আসে জানালার ফাঁক গলে। ড. সরকার আবদুল মান্নান নিজের জীবনের সেইসব গল্পই ধুলোর চাদর সরিয়ে পাঠকের সামনে হাজির করছেন। নিজের জীবনের সাথেও তো মিলে যায় কত কিছু!
যে পুস্তক পাঠ করিলে.. .
‘যে পুস্তক পাঠ করিলে ভাষা শুদ্ধ। যে পুস্তক পাঠ করিলে ভাষা শুদ্ধ। যে পুস্তক পাঠ করিলে ভাষা শুদ্ধ। রূপে পড়িতে বলিতে। রূপে পড়িতে বলিতে। রূপে পড়িতে বলিতে। ও লিখিতে। ও লিখিতে। ও লিখিতে। পারা যায়। পারা যায়। পারা যায়। তাহাকে ব্যাকরণ বলে। তাহাকে ব্যাকরণ বলে। তাহাকে ব্যাকরণ বলে।’
উচ্চৈঃস্বরে আমি যখন ব্যাকরণের সংজ্ঞা মুখস্থ করছিলাম তখন বড় বাই রুহুল আমিন ঘরে ঢুকল। কোনো রকম অনুমতি না নিয়ে সোজা আমার কানে ধরে বলল,
‘কী পড়ছ এডি? পড়া, না পড়ার মাতা? বালা কইরা পড়।’
কিন্তু কীভাবে ভালো করে পড়তে হবে তার কোনো নির্দেশনা না-দিয়ে সে চলে গেল। আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। আরও জোরে পড়তে হবে, নাকি আস্তে আ¯েÍ, নাকি ধীরে ধীরে বুঝতে না-পেরে মাকে ডাকলাম।
‘মা, ও মা। আমনের পুতে আমার পড়া নষ্ট করল। এহন আমি ক্যামনে পরমু?’
মা কিছুতেই বুঝতে পারলেন না পড়া আবার নষ্ট করে কীভাবে। লবণ বেশি পড়লে তরকারি নষ্ট হয়। দুধের মধ্যে চনা পড়লে দুধ নষ্ট হয়- এসব মা জানেন। কিন্তু পড়া নষ্ট হয় কীভাবে, তা জানেন না। পড়ার জন্য মনোযোগ দরকার, একাগ্রতা দরকার, নিষ্ঠা দরকার। আমি সেভাবেই পড়ছিলাম। ভাই এসে কান মোচড়িয়ে দিলে সেই মনোযোগ একাগ্রতা ও নিষ্ঠা কি আর থাকে? থাকে না। আমি সেটাকেই বলছিলাম পড়া নষ্ট। মা কিছুই বুঝলেন না। বললেন,
‘পড়া নষ্ট কি রে? পড়া কি ছালুন যে নুন বেশি পইড়া গেছে! পড়! ভালা কইরা চৌক-কান খুইল্যা পড়।’
মার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। চোখ-কান বন্ধ করে কি কেউ পড়ে, না পড়তে পারে? আমি সব সময় চোখ-কান খোলা রেখেই পড়ি। মা-র কথা শোনার পর উলটোটা করে দেখলাম। চোখ বন্ধ করে পড়তে চেষ্টা করলাম। কিন্তু পড়ব কীভাবে? দেখাই তো যায় না। কান বন্ধ করে পড়া যায়। কিন্তু স্পষ্ট করে কিছুই শোনা যায় না। মাকে আবার ডাকলাম।
‘ও মা, মা।’
মা বললে, ‘আবার কী অইল? ডাহাডাহি করছ কিলিগা?’
আমি বললাম, ‘আমনে যে কইলেন চৌখ-কান খোলা রাইখ্যা পড়তে। চৌখ-কান বন্ধ কইরা কি কেউ পড়ে, না পড়তে পারে?’
মা বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘তোরে লইয়া একটা জ্বালা। একটা কতা কইলে একশডা কতা জিগাছ। চৌখ-কান খোলা অইল মোন দিয়া পড়া। বুঝলি? মোন দিয়া পড়া।’
মা-র কথা শুনে আমি আরও সমস্যায় পড়ে গেলাম। মন দিয়া পড়ার কথাটা অনেকবার শুনেছি। কিন্তু মন কী জিনিস- বুঝি না। আবার মাকে ডাকলাম,
‘মা, ও মা।’
দুই তিনবার ডাকার পর মা মহা বিরক্ত হয়ে বললেন,
‘আবার কি রে? তুই কি পড়বি না ডাহাডাহি করবি?’
আমি বললাম, ‘মা, মন কী?’
মা একটু চুপ হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে বললেন, ‘মোন কি আমি ক্যামনে কমু! তোর বাহেরে জিগাইস।’
বাবা ঘরে ছিলেন না। কিন্তু থাকলে ভালো হতো। মন নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ কিছু কথা বলতেন যার কিছুই আমি বুঝতাম না। তবে প্রশ্নের পিঠে অনেক প্রশ্ন করলেও মা-র মতো বাবা একটুও রাগ করতেন না। বাবা কী করে যেন জেনেছিলেন যে, শিশুরা পৃথিবীতে নতুন এবং পৃথিবীও তাদের কাছে নতুন। তাই তাদের অনেক প্রশ্ন থাকে। বড়রা অনেক দিন ধরে পৃথিবী দেখছে, জানছে। তাদের উচিত ছোটদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া। তবে সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায় না, পারাও যায় না। সে ক্ষেত্রে রাগারাগি না করে বুঝিয়ে বলাই ভালো।
কিন্তু বাবাকে পাই কোথায়? তিনি ব্যস্ত মানুষ। গ্রামের বিচার-আচার নিয়ে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকেন। এমন সময় ঘরে ঢুকল বকর ভাই। মেধাবী ছাত্র হিসেবে তার অনেক সুনাম। পড়ে ক্লাস সেভেনে। তাকেই জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আচ্ছা বকর ভাই, মন কী?’
অবাক হয়ে বকর ভাই উলটো আমাকেই জিজ্ঞাসা করল, ‘মন কী মানে কি রে?’
আমি বিনয়ের সঙ্গে বললাম, ‘এই যে কয় না- মন দিয়া পড়, মন দিয়া পড়। এই মন কী?’
বিনয়ে কোনো কাজ হলো না। সম্ভবত উত্তম-মধ্যম খেয়ে এসেছে জেঠির কাছ থেকে। আমার উপর সেই ঝাল মিটানোর জন্য ঠেসে আমার কানটা ধরল। তারপর বলল, ‘খুব পাকনা অইছস, না! মন কী? মন তোর মাতা। তোর কাম অইল মন দিয়া পড়া। মন কী- এইডা দিয়া তোর দরকার কী?’ বলে হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। এবং যাওয়ার সময় আমাকে একটা চর দিয়ে গেল।
চর খেয়ে আমি চিৎকার-চেঁচামেচি করে কাঁদছিলাম। তখন ঘরে ঢুকল আমার ছোট কাকা।
ছোট কাকা কোনো দিন স্কুলে যায়নি। কখনো পড়াশোনা করেনি। কিন্তু আমাদের অনেক প্রশ্নের উত্তর দেয় ছোট কাকা। ছোট কাকার উত্তর সঠিক কি বেঠিক এই প্রশ্ন কখনই আমাদের মধ্যে জাগেনি। বিরক্ত না-হয়ে উত্তর দেয়- এতেই আমরা খুশি। একই প্রশ্ন কাকুকে জিজ্ঞাস করতে হলো না। আমার কান্নার কারণ ও বিবরণ শুনে বলল, ‘তুই ওই ফাজিলডার কাছে জিগাইছস কিলিগা? ও কিছু জানে?’
বকর ভাইকে যখন কাকু এই সব অপমানজনক কথাবার্তা বলছে তখন আমি খুশি হয়ে কান্না থামিয়ে দিলাম।
কাকু বলল, ‘হোন, হুদা পড়া না। সব কাজই মন দিয়া করা লাগে। তয় মন অইল… ক্যামনে কইতাম?’
এই প্রথম দেখলাম কাকু বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে। আমি চাই না কাকু এই বেহাল দশায় থাকুক। তাই বললাম, ‘বুজছি কাকু। আমনের কঅন লাগত না। মন দিয়া পড়তে অইব।’
কাকু মনে হয় হাপ ছেড়ে বাঁচল।
বলল, ‘হ। এইডাই আসল কতা। মন দিয়া পড়তে অইব। মন কী জিনিস এইডা না-জানলেও অইব। পড়াডা অইল আসল কতা।’
আমি বাংলা ব্যাকরণ বাদ দিয়ে ইংরেজি শব্দার্থ মুখস্থ করতে শুরু করলাম,
‘মেডিসিন অর্থ রোপণ করা… মেডিসিন অর্থ রোপণ করা… মেডিসিন অর্থ রোপণ করা।’
মুখস্থ করার কাজটি ভালোভাবেই করছিলাম। কোথাও কোনো সমস্যা হচ্ছে বলে মনে হলো না। কিন্তু সমস্যা করে ফেলল শাহজাহান ভাই। পিছন থেকে এসে অকস্মাৎ পিঠে একটি তাপ্পর লাগিয়ে বলল, ‘এই গাধা! কী কছ এডি?’
ঘটনার আকস্মিকতায় আমি কিছুক্ষণ বুঝতেই পারলাম না যে আমি কী বলছি। তারপর শাহজাহান ভাই আমার সামনে থেকে বইটি ছোঁ মেরে টেনে নিয়ে বলল, ‘দেহা। মেডিসিন অর্থ রোপণ করা কই লেহা আছে?’
আমি ওর হাত থেকে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বইটি নিলাম। তারপর বললাম, ‘‘মারেন কিলিগা? এই দেহেন।’
ও দেখল। দেখে দ্বন্দ্বে পড়ে থাকল কয়েক সেকেন্ড। তারপর অধিক জোরে আমার পিঠে আর একটি কিল বসিয়ে দিয়ে বলল, ‘‘চৌখ খাইছস? দেহস না চৌখে কিছু। পাতাডা ভাইঙ্গা আইয়া রইসে, ‘হেইডাও দেহস না? নে, ‘পড়। মেডিসিন অর্থ ঔষধ।’
এর মধ্যে বড় আপা চলে এসেছে। শাহজাহানকে আচ্ছা মতো ঝারি দিয়ে বলল, ‘‘তুই কত পারছ! বছর বছর পরীক্ষায় ফেইল করছ। তুই আইছস পড়ার লাইগ্যা ওরে মারতে! এই কালাকুইট্টা! আয়। তোর পড়ন লাগব না।’
এই বলে আপা আমাকে কোলে করে দক্ষিণের পুকুরের দিকে নিয়ে গেল।
পড় দিন স্কুলে গেলাম। সানকী ভাঙ্গা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। রাজ্জাক স্যার বাংলা পড়ান। স্যার প্রতিদিন একটি বেত নিয়ে ক্লাসে ঢোকেন। চেয়ারে বসার আগে বেত দিয়ে সশব্দে টেবিলের উপর বাড়ি দেন। বিকট শব্দে প্রথমে আমরা চমকে উঠতাম। এখন সবাই অভ্যস্ত হয়ে গেছি। রাজ্জাক স্যার সারাক্ষণ হাসিখুশি মানুষ। গল্পপ্রিয় মানুষ। বেত দিয়ে কাউকে কখনো পিটিয়েছেন বলে মনে পড়ে না। এক সময় আমাকে বললেন, ‘‘বল তো দেহি ব্যাকরণ কাহাকে বলে?’
আমি বলতে লাগলাম, ‘
‘যে পুস্তক পাঠ করিলে ভাষা শুদ্ধ… যে পুস্তক পাঠ করিলে ভাষা শুদ্ধ। যে পুস্তক পাঠ করিলে ভাষা শুদ্ধ। রূপে পড়িতে বলিতে… রূপে পড়িতে বলিতে… রূপে পড়িতে বলিতে…’
স্যার আমাকে শেষ করতে দিলেন না।
বললেন, ‘‘থাম থাম। এডি কী কস তুই? ক্লাসে আইসা পড়া মুখস্থ করতাছস? বালা কইরা পড়বি।’ ক্লাসের সবাই কী নিয়ে হাসাহাসি করছিল। রাজ্জাক স্যারও হাসাহাসি করছিলেন। সমস্যাটা কোথায় আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু খুব অপমানিত বোধ করছিলাম।
ক্লাস শেষে রাজ্জাক স্যার আমাকে ডাকলেন। আমি স্যারদের বসার রুমে গেলাম।
রাজ্জাক স্যার আমাকে বললেন, ‘‘আমার লগে কবি । ঠিক আছে?’
আমি বললাম, ‘‘জি স্যার।’
কিন্তু স্যারের সঙ্গে কী বলব তা এখনও জানতে পারিনি।
কিছুক্ষণ পর স্যার বললেন, ‘যে পুস্তক পাঠ করিলে ভাষা শুদ্ধ রূপে পড়িতে, বলিতে ও লিখিতে পারা যায় তাহাকে ব্যাকরণ বলে।’
আমি স্যারের সঙ্গে বললাম। বেশ কয়েকবার।
স্যার বললেন, ‘সোন্দর অইছে। এখন ক, কী বুঝলি?’
আমি চুপ করে থাকলাম।
স্যার শুদ্ধ করে বললেন, ‘শুন সব কিছু ভালো করে শেখার জন্য নিয়ম-কানুনের বই আছে। বুঝছ? এই যে আমি কথা বলছি, তুমি কথা বলছ। কখনো কখনো লেখ এর নাম কী, বল।’
আমি বললাম, ‘স্যার ভাষা।’
‘গুড।’
স্যার উৎসাহ দিয়ে বললেন। ‘এই ভাষা শুদ্ধ করে বলার জন্য, পড়ার জন্য, লেখার জন্য কী আছে- বই পুস্তক আছে। বুঝছ? এগুলোকে বলে ব্যাকরণ। যাও। ভালো করে পড়বে।’
রাতে আমি বড় ভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ভাইজু, স্কুলে থার্ড স্যার কইছে ভাষা শিখার নিয়ম আছে। আমরা সবাই তো কতা কই। নিয়ম কবে শিখলাম?’
ভাই বলল, ‘দরকার নাই। আমরা কতা কই আঞ্চলিক ভাষায়। আঞ্চলিক ভাষায় কতা কই জন্মের পর থিকা। নিয়ম অইয়া আছে। শিখনের দরকার নাই।’
ভাইয়ের কথা কিছুই বুঝলাম না। তবু বললাম, ‘তাইলে কোন ভাষা শিখতে অয়?’
ভাই বেশ একটা গাম্ভির্য নিয়ে বলল, ‘প্রমিত ভাষা। যেই ভাষায় বই লেখা অয়, যেই ভাষায় শিক্ষিত লোকেরা কতাবার্তা কয়।’
আমি এবারও কিছুই বুঝলাম না। প্রসঙ্গ অন্যদিকে নেওয়ার জন্য বললাম, ‘ভাইজু, বাংলা বাদে আর কী কী ভাষা আছে।’
ভাই বলল, ‘আরে অনেক, অনেক। কইয়া শেষ করন যাইব না। ইংরেজি, আরবি, ফার্সি, উর্দু, হিন্দি, তামিল…।’
আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম, ‘আরবি ভাষায় মাইনসে কতা কয়? আরবি ভাষায় তো শুধু আজান দেয় আর নমাজ পড়ে।’
ভাই বলল, ‘আরে না না। আমাগ দেশের মানুষ আজান দেয়, নমাজ পড়ে, দোয়াকালাম পড়ে। কিন্তু সৌদি আরবের মানুষেরা কতা কয় আরবি ভাষায়। বুঝলি?’
আমি বললাম, ‘আচ্ছা ভাইজু! তাইলে সৌদি আরবের মাইনসের তো অনেক ছোয়াব অয়।’
‘পড় পড়। সব ভাষাই ছোয়াবের’- বলে বড় ভাই চলে গেল। সব ভাষাই কী করে ছোয়াবের হয়- এই প্রশ্ন কাকে করব। এই প্রশ্ন মাথায় নিয়ে আমি ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম।
চলবে