শিশুদের সুন্দর হস্তাক্ষর প্রতিযোগিতা
অমনোযোগী মায়েদের দেখি ছায়ার সেলাই খুলে গেছে, যুক্তাক্ষরের ছুটন্ত অক্ষরদল। ‘ভোর হল দোর খোল’ এই আহবানে ভোরের দুয়ার খুলে ঝাঁকে ঝাঁকে উল্লসিত শিশুদের সাথে অনেক পুড়িয়ে কাঠ, পেরিয়ে চড়াই, চড়–ই গ্রীবার মতো বেখেয়ালে ব্রার বিভ্রান্ত রেখা, চিহ্নছুঁই আর ছায়াতলে শ্যাম রাখা কাঁপা কাঁপা বেভুল শ্রবণ। সারি সারি রাখ-ঢাক কিছু রাখে নাই; এখন পোড়ানো বেলা, খুকুমণি বিলম্বে জেগেছে। শাখে শাখে দুষ্টগান জিরাফের গলা উঠিতেছে। সরু অক্ষরের মতো সরু শিশুদল অবাক পেঁচিয়ে আনে পঙক্তির সমস্ত বিকল কলকজ্বা নড়ে যায় অবিকল পৃষ্ঠার পিঠে পুড়ে যায় পিঠ; ‘তুলি হাল খুলি পাল’ মাঠের জোয়ারে। অনেক পোড়ানো হলো অক্ষরের তীক্ষ্মমুখ সুষমাশরীর, বাক্যের টানটান, খুকুমণি চোখ মেলে দুপুর উজাড়; বিন্দু বিন্দু কমা আর কোলনের পর বিলম্বিত দাড়ি।
বেভুল সমস্ত দিকে মায়েদের পাড়ি।
বিপ্লবীর মৃত্যু
বাহুডোরে বাঁধা পড়বার আগে তাঁর মুঠি ছিল আকাশে উত্তোলিত। আক্রমণটা এমন আচম্বিত যে, তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। পূর্বে তাঁর বিক্ষুব্ধ চীৎকারের বাতাসের কানে তালা লেগে যেত, শোষকের প্রাসাদ হয়তো নড়ত না, তবে তরুণদের ভেতর নড়ে উঠত বোধ, নিজে তেজী ছিলেন, তেজ জাগাতে তার বাক্যবিন্যাস ছিল প্রতিভাপূর্ণ!
আজ তাঁর গলা থেকে কণ্ঠস্বরকে চুরি করে নিয়ে গেছে। সহস্র পুলিশের বেষ্টনীতে যিনি ঝড়ের দাপটে অতিক্রম করে যেতেন, তিনি আজ একটি নরম বেষ্টনীকে ছিঁড়ে যেতে পারছেন না। তিনি জানতেন না এদের শক্তি, অন্তঃস্থ বৃত্তের পরিসীমা। সুখে, সঙ্গমে, সন্তানে কি ছিল মহাকর্ষ বাঁধা।
বাহুডোরে বাঁধা পড়বার আগে তিনি পৃথিবী জয়ের স্বপ্ন দেখতেন। আক্রমণটা এতই অভাবিত যে তিনি টেরই পেলেন না কখন পরাস্ত হলেন, কখন মুঠি খুলে গেছে, গলা হতে নেমে গেছে স্বর।
যুদ্ধক্ষেত্র
আমি সেই প্রান্তরের দিকে তাকাই, মুহূর্তে ঝিলিক্ দিয়ে ওঠে দশসহস্য তরবারি আর বর্শার ফলা! অশ্বখুরধ্বনি কানে আসে, কানে আসে মারণভেদী চীৎকার! ওরা কি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল, ধাবমান অশ্বপিঠে ওরা কতজন? আজ সম্পূর্ণ নামহীন, এমন কি সংখ্যাহীন। প্রান্তরের শান্তশ্রী দেখে মনেও হয় না ওখানে কোনো যুদ্ধ হয়েছিল।
যাদুঘরে রক্ষিত বর্শাটির দিকে তাকাই। কোন বীর যোদ্ধা এটি ছুঁড়েছিল পলায়নপর শত্রুর দিকে; এর আপাতনিরীহ লোহার ভেতর কত খুনই না ঘটে গেছে, আর এর দীর্ঘ শরীরে হাত পড়েছে কত খুনি প্রজন্মের!
মানুষের কীর্তিগাথাও তবে উল্লেখযোগ্য নয়। সে হারিয়ে যায়; যেন হাওয়ার তসতরি হতে রাশি রাশি শূন্যতাই ঝরে পড়েছিল প্রান্তরের টেবিলে। আর মানুষের চেয়ে তার মারনাস্ত্রেরাই দীর্ঘজীবি!
প্রকৃতিবাজারে
ফর্সা মোহরের মতো পকেটে খরচ করার কিছু কাঁচামুদ্রা ছিল। কী এক উচ্চাশা চাপল, ভাবলাম, কিছু কেনাকাটা করা যাক। শেষ সন্ধ্যায় আকাশটা ভারি কোমল বর্ণময়, দেখে লোভ হলো। ভাবলাম ওর তো শেষ নেই, একটা ছোট্ট অংশ না হয় কিনি। ‘বিক্রিযোগ্য নয়’ বলে সাফ সাফ জানিয়ে দিল আল্লাহর ফেরেশতারা। বাতাস বইছিল মৃদু, প্রাণজুড়ানো; ভাবলাম এ তো অঢেল, নিশ্চয়ই তত দামি হবে না। বাতাসের একটু ক্ষুদ্র আঁচল কিনতেই পকেট অর্ধেক হয়ে গেল। বাকি মুদ্রা নিয়ে আলো, বালিকার হাসি, পাহাড়ের পিঠÑ যা যা কিছু কিনতে চাইরাম কোনোটাই সাধ্যে কুলাল না। ফাল্গুনের একটি মনোরম সন্ধ্যা কিনতে আমি ফতুর হয়ে গেলাম।
বাড়ি ফিরলাম অবশ্য চতুর্গুন ধনী হয়ে। একটা পূর্ণ ফাগুন পকেটে নিয়ে; ত্বক হয়ে উঠল বহুবর্ণময়, কেশদাম আলো উদ্ভাসিত, চোখে অপরূপ দৃশ্যময়তা, বুকে প্রাণখোলা হাওয়া।
সেই থেকে আমি ফাগুনের নিজস্ব ঘরানার লোক, আগুনের স্পর্ধিত কবি।
ঈশ্বরের মুখ
এক সন্ধ্যায় তোমার সাথে দেখা হলো ঈশ্বর! সমগ্র আকাশ জুড়ে সে কী উদ্ভাসন, সে কী স্বপ্নশুভ্রনীল! সমগ্র আকাশ জুড়ে সে কী উদ্ভাসন, সে কী স্বপ্নশুভ্রনীল! ময়ূরের পালকও এত সুন্দর নয়; কী নাম দিই সেই সুন্দরের, ভেবে ভেবে তোমারই নাম মনে এল।
সন্ধ্যা তখন রাত্রির বুকে বিলীন হচ্ছে, এত স্তব্ধ অরণ্যানীর পাশ দিয়ে ছুটছিল আমাদের পেখমতোলা গাড়ি, খুব অল্প আলোর ভেতর বৃক্ষদের ঐ রকম সংবদ্ধতা ঐরকম ভীত পিছু দৌড়, শীর্ষজুড়ে কত যে রহস্যের পর্দা নেমেছিল। সেই পরিব্যপ্ত রহস্যময়তার বুক চিরে তোমাকে দেখলাম; আমি কি ভুল দেখেছি?
আজ সমস্ত সৌন্দর্যের পাশে চোখে পড়ে, উঁকি দিয়ে যাও। বহুকাল তোমাকে পাইনি দেখতে, পোড়া চোখে কি আন্ধার ঠুলি! এখন প্রতিটি দৃশ্যের পাশে বাকহীন স্তব্ধ বিস্মিত থাকি পাখি, আর ডাকি তব নাম, মন্ত্রমুগ্ধ অনির্ণেয় তোমারই অবয়ব ভাবে চোখে।