[কবিতার এক অনবদ্য বিষয় ভ্রমণ কবিতা। কবিতা পাঠের সাথে সাথে মনের সিনেরিলেও ভেসে ওঠে ওইসব স্থান যাতে কবির পর্যটন। পাঠকের মনের ভিতরও পঙক্তির পর পঙক্তি পাঠের সাথে সাথে দৃশ্যের পর দৃশ্য ভেসে ওঠে। এতে কবিতা পাঠের পর ভ্রমণগদ্যেরও একটু স্বাদ নেয়া যায়।এফ ট্রেনের কবিতা তেমনই।
কবি বলেন, নিউইয়র্কের পাতাল রেল এফ ট্রেন ধরে অফিসে যেতে সময় লাগে ৪০ মিনিট। আসা-যাওয়ার পথে, প্রতিদিনের দেখা দৃশ্য, শব্দ-ছন্দে তুলে ধরা হয়েছে এই কবিতায়।কবি কাজী জহিরুল ইসলাম ট্রেনে বসেই লিখে ফেলেন কিছু অনবদ্য পঙক্তি। তারই একগুচ্ছ আজ আড্ডাপত্রের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।]- সম্পাদক
ইন্দ্রলোকের পরী
সন্ধ্যার এফ ট্রেন লোকে ঠাসাঠাসি
বহুজাত মানুষের সান্ধ্য-আড়ত।
কালো চুল, খাড়া নাক
ছিপছিপে শ্যমলা সে,
কাছে গিয়ে বলি তাকে, বাড়ি?
হাসি দিয়ে উর্বশী জানায়, ভারত।
আমি তার চোখ দেখি
স্বপ্নের ভারে ঢুলুঢুলু
স্বদেশের নাম বলে ডান হাত বাড়াতেই
খুশিতে মেয়েটি দেয় উলু।
এগহার্ট টোল হাতে অপেক্ষা সয় বুঝি তার
আজকের ক্ষণটাই আনন্দ-ভরা সম্ভার।
মেয়েটির দুই পায়ে দৃঢ় প্রত্যয়
প্রতিকূল পৃথিবীকে করবে সে জয়।
ইন্দ্রলোকের পরী অদ্রিকা নারী অপরূপা
ট্রেন থেকে নেমে তুমি
পঙ্কিল এ-শহরে বাড়াও দুপা।
জ্যামাইকা, নিউইয়র্ক। ২০ অক্টোবর ২০২২।
মেয়েটা কী চীনে?
মেয়েটা কী চীনে?
শীতের সকালে তার গায়ে ফিনফিনে
তুষার শুভ্র এক জামা
আমি কী লিখবো ওর জন্যে এখনই এক
কবুয়তনামা?
সুন্দর ছোটো চোখ, ভ্রূ দুটি ধারালো, আঁকা পেন্সিলে
দুই পায়ে তবলার জাদুকরী বোল তোলে
উঁচু হাইহিলে।
মেয়েটা কী চীনে?
প্লাটফর্ম শপ থেকে
এক ঝাড় গোলাপের ফুল নিলো কিনে।
যখন সে হাইহিলে ঝড় তুলে হাঁটে
থলের বেড়াল দুটি চুপচাপ গুটিশুটি
মেয়েটির বুকে শুয়ে গোস্যায় ফাটে।
কালো চুল নাক বোঁচা গোলাপের আভা ঠোঁটে
হাসি দিলে রাশি রাশি স্বর্গের ফুল ফোটে
পৃথিবী ছোঁয়নি তাকে ফ্রেশ আনকোরা
কার কাছে যাচ্ছে সে হাতে নিয়ে তোড়া,
উজ্জ্বল রোদমাখা ঝকঝকে দিনে?
মেয়েটা কী চীনে?
এফ ট্রেন (জ্যামাইকা টু ম্যানহাটন) । ২০ অক্টোবর ২০২২।
ম্যানহাটন
স্ট্রিটগুলো জলে ভাসা কুমিরের দাঁত
এভিনিউগুলো এক ভয়াল করাত
শহরটা আঁড়ে-ঠারে ফালি ফালি কাটা
রেল, বাস, মানুষের একসাথে হাঁটা।
পাতালের অজগর হিস করে আসে
প্লাটফর্ম পেয়ে গেলে হঠাৎ সে ভাসে
বক্ষের ঢাকনাটা খুলে দিয়ে ডাকে
মানুষেরা তার বুকে ঢোকে ঝাঁকে ঝাঁকে।
কেউ শাদা কেউ কালো শ্যামলাও আছে
সকলেই পাশাপাশি, বসে কাছে কাছে
কারো নাক বোঁচা কারো খুব বেশি খাড়া
সংসারী, কর্মঠ, কেউ গৃহহারা।
সোনা-রঙ চুল যার নীল দুটি চোখ
বিরক্তি মুখে তার রাজ্যের শোক
উঁচু জাত দৃষ্টিতে কুঞ্চিত নাক
অন্যরা যেন ঘাস, তৃণ, ছত্রাক।
নানা জাত ধর্ম ও কৃষ্টির বাস
শান্তি ও বিভেদের কত ইতিহাস
এ-শহর প্রতিদিন লিখে রেখে যায়
ভোরে সুখ, দুঃখটা আসে সন্ধ্যায়।
এফ ট্রেন (ম্যানহাটন টু জ্যামাইকা)। ২৫ আগস্ট ২০২২।
অভিবাস
শাদা জুতো কালো জিন্স ওপরে টি-শার্ট
মেয়েটি স্মার্ট।
চোখে-মুখে ঝড়ো গতি ঠোঁটে হাসি মাখা
চিবুকটা ঢাকা।
সেলফোনে চোখ রেখে খোঁজে কী সে রোজ
আনন্দ-ভোজ।
বহুদূরে ফেলে আসা তামাউলিপাস
স্বপ্নের চাষ।
উড়ে আসে চাচালাকা হৃদয়ের ডালে
স্মৃতি চমকালে।
হৃদবৃক্ষের শাখা মেলে দেয় বোধ
টুলুকার রোদ।
স্বপ্নের চাষ এই দূর পরবাসে
দীর্ঘশ্বাসে।
দুঃখটা লুকিয়ে সে তবু রোজ হাসে
কর্মে ও বাসে।
এফ ট্রেন (জ্যামাইকা টু ম্যানহাটন)। ২৪ আগস্ট ২০২২।
দেহতরী
দেহতরী ঘাট পেল চল্লিশে এসে
পথে পথে কত ঢেউ নদী গেল ভেসে।
এবার সে নেমে যাবে ঘন লোকালয়ে
স্বপ্নের পাখাগুলো লুকোবে না ভয়ে।
অলি-গলি রাজপথ রেস্তোরা মল
সন্ধ্যায় বাতি জ্বলে কত উজ্জ্বল।
উঁচু উঁচু দালানের ছায়া পড়ে গায়ে
পথগুলো ছোট হয় পথিকের পায়ে।
মানুষের ভিড় ঠেলে কোনো এক ফ্লাটে
কাউকে সে খুঁজে পাবে রোজ তাই হাঁটে।
নাম-ধাম জানে না সে ঠিকানাও নেই
বিশ্বাসে আছে জোর খুঁজে সে পাবেই।
কেউ তাকে নাম ধরে দিলো বুঝি ডাক
একবার ভাবে যাই, ফের ভাবে থাক।
এফ ট্রেন (ম্যানহাটন টু জ্যামাইকা)। ২২ আগস্ট ২০২২।