জাফরুল আহসান
আমাদের যাপিত জীবনের দৈর্ঘ্য খুব একটা দীর্ঘ নয়, নয় প্রশস্থ। বিত্ত- বৈভব, সুখ- দুঃখ, আনন্দ-বেদনা এমনি নানাবিধ টানাপোড়েনের মাঝে; সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গতি আর অসঙ্গতির মাঝেই নাতিদীর্ঘ বন্ধুর পথটি হেঁটে যেতে হয় আমাদের। চলার পথে ত্যাগ ও সাধনার বেড়ে ওঠা জীবন বৃক্ষের সুশীতল ছায়াতলে দাঁড়িয়ে খালিকটা পেছনে তাকালে মানসপটে ভেসে উঠে মেধা ও মননের নিবিড় পরিচর্যায় সাজানো ফুলবাগান। বাগানের মালির ঘামে ও শ্রমে পরম মমতায় লাগালো ফুলগাছগুলো নানা বর্ণে নানা রঙে বাহারি সব ফুলে দোল খাচ্ছে বাতাসে। দৃষ্টি কেড়ে নেয় পথিকের স্মৃতির প্রজাপ্রতিরা উড়ে বেড়ায় ফুলে-ফুলে। বাতাসে ডিগবাজি দেয়া ঘাস ফড়িং এর মৃদু সন্তরণ আর ফুলের সুবাসে মালির চোখের কোন জুড়ে বেয়ে পরে দু’ফোটা আনন্দ অশ্রু। এ যে একজন পরিতৃপ্ত মালির সার্থকতা। কাব্যকলায় পারদর্শী এমনি একজন মালি কবি ও গীতিকার মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানের কথা বলছিলাম।
বিশাল তাঁর সৃষ্টি ভান্ডার, আকাশ ছোঁয়া যার জনপ্রিয়তা। গানের কবিতা অথবা কবিতায় গান যে ভাবেই বলি না কেন মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানের সৃষ্টিকর্ম নিয়ে সমালোচনা করার মতো বিজ্ঞজন আমি নই। তাঁর কাব্য মূল্যায়ন প্রসঙ্গে আলোচনা করার মেধা ও স্পর্ধা, তাও আমার নেই। অতএব দুঃসাহস নাই বা দেখালাম। তবে কবির জন্মদিনে কবি প্রসঙ্গে, তাঁর সৃষ্টির বিশাল সম্রাজ্য না হয় ঘুরে ফিরে দেখে নেবো কিছুটা সময়।
১৯৪৩ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি ঝিনাইদহের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয়া শিশুটি আজ পচাত্তর অতিক্রান্ত, পা রেখেছে ৭৬এ। কালের নিরিখে পঁচাত্তর বছর খুব একটা সময় নয়, সময়ের যাদুঘরে যা অনু-পরমানু তুল্য। কিন্তু জীবন পরিক্রমায় পঁচাত্তর অতিক্রম করতে মনের দিক থেকে তিনি এখনও তরুণ। এ তারুণ্য শেষ হবার নয়। টগবগে তরুনের জন্মদিনে আমার শ্রদ্ধা রইলো।
কৈশোর থেকেই লেখা-লেখির প্রতি মাত্রাতিরিক্ত ঝোক ছিলো তাঁর। ছড়া, কবিতা, গান গল্প, প্রবন্ধ, নাটক, কাহিনী-চিত্রনাট্য ও সিনেমার সংলাপ। কি লিখেন নি তিনি। বলা যায় সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় ছিলো তাঁর অবাধ বিতরণ। এমনকি জাতীয় পত্রিকায়ও কলাম লিখেছেন। এ যাবত তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা চৌদ্দটি। তাঁর সর্বশেষ গ্রন্থ ‘নির্বাচিত গান হৃদয়ের ধ্বনিগুলি’ সর্বমোট ৪৯০টি কবিতা/গান দিয়ে সাজানো সংকলন টি।
নির্বাচিত গান হৃদয়ের ধ্বনিগুলি প্রসঙ্ঘে কবি তাঁর বইয়ে ১ম ফ্ল্যাপে লেখেছেন-
“ নাম রাখতে চেয়েছিলাম ‘নির্বাচিত গানের কবিতা’ প্রকাশক সাহেবের তাতে প্রবল আপত্তি। এতে নাকি ক্রেতা বিভ্রান্ত হবেন, ভাববেন কবিতার বই। তার বক্তব্য বিগত কয়েক বছর ধরে মেলায় হাজার হাজার মানুষ জানতে চেয়েছেন আমার রচিত কোন গানের বই বেরিয়েছে কি না? আমি যতই বলি গান তো মানুষ শোনেন। এই গ্রন্থে যা মুদ্রিত হবে তা তো গ্রন্থের পাতা খুলে শোনা যাবে না। পড়া যাবে। ফলে এগুলো তো কবিতাই। বড় জোর বলায় যায় গানের জন্য রচিত কবিতা ”
গানের জন্য রচিত কবিতা বা গানের কবিতা যে নামেই উচ্চারণ করি না কেন, তার গীতিময়তার কারণে কবিতাগুলো আপনা-আপনিই গান হয়ে গেছে। প্রেম ও প্রকৃতি, আশা-নিরাশা আর শূন্যতাবোধ তাঁর কবিতার অনিবার্য অনুষঙ্গ। বাংলাদেশের নামি-দামি প্রতিটি শিল্পীর কণ্ঠে তাঁর গান পেয়েছে ভিন্ন মাত্রা। বহুমাতৃকতার কারণে তাঁর গান আজ মানুষের মুখে মুখে। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে প্রবাসেও তাঁর গান জনপ্রিয়। তাই কবি ও গীতিকার মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানের লেখা-লেখির পাশাপাশি তিনি দেশকে প্রতিনিধিত্ব করেন নিজের মতো করে।
মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান কি বলতে চান? সে প্রশ্নের জবাব মিলবে তাঁর কবিতায় পাঠ করলেই। দেশ-প্রেম, সমাজ সচেনতা তাঁর দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গী কিংবা মানব-মানবীর চিরায়ত প্রেম তাঁর কবিতার মূল উপজীব্য বিষয়। ‘নির্বাচিত গান হৃদয়ের ধ্বনিগুলি’ গ্রন্থে ৪৯০টি গানের কবিতাকে তিনি সর্বমোট ছয়টি পর্বে ভাগ করে সূচি সাজিয়েছেন।
যেমনঃ ১. চির অক্ষয় তুমি [ শেষ ও ভাষা ] ২. হায়রে হৃদয় [ প্রেম ও গজল ] ৩. কতো যে কথা জাগে [ অনুভব প্রাসঙ্গিক ভাবনা ] ৪. ছয় ঋতু বারো মাস [ ঋতুভিত্তিক ] ৫. সৃজন চলমান [ ছায়া-ছবির গান ] ৬. একান্তে তুমি আমি [ সুফি বাউলতত্ত ]।
গ্রন্থটির পাঠ প্রতিক্রিয়ায় বলা যায়- তাঁর ভাবাবেগ তাঁর উপলব্ধি আর মননশীলতার গুনেই তাঁর লেখার ধরণ স্বতন্ত্র। এই যে নিজস্ব একটি ধারা নির্মাণ করার কারনেই তাঁর সৃষ্টিকে আলাদা ভাবে চিনে নেয়া যায়। চির অক্ষয় পর্ব থেকে [ দেশ ও ভাষা ] তুলে ধরছি উদ্ধৃতাংশ-
অ. চির অক্ষয় তুমি বাংলাদেশ
চির দুর্জয় তুমি বাংলাদেশ
চির অক্ষয় চির দুর্জয়
চির নির্ভয় তুমি বাংলাদেশ।। [ পৃষ্ঠা–২৩ ]
অথবা
আ. নকশী কাথার নকশী তোলা হাতে
কাঁকনে সুর, বাজে আমার
এক তারারই সাথে
সেই রূপসীর অঙ্গ যেন
ভরা নদীর মতোই ভরা কাঁচা হলুদ বাটা।। [ পৃষ্ঠা–৭৫ ]
হায়রে হৃদয় [ প্রেম ও গজল ] পর্ব থেকে আরো দুটি উদ্ধৃতি তুলে ধরছি-
অ. পাহাড়ের- কান্না দেখে তোমরা তাকে ঝর্ণা বলো
ঐ পাহাড়টা বোবা বলেই কিছু বলে না,
তোমরা কেন বোঝ না যে
কারো বুকের দুঃখ নিয়ে কাব্য চলে না।। [ পৃষ্ঠা–৮৮ ]
আ. কখনো বা ‘তুমি’ বলি কখনো বা ‘তুই’
কখনো চেয়েই থাকি, কখনো বা ছুঁই
ভালোবাসা হয়ে যায়
সারা বুকে সুবাসিত জুই।।
একজন কবি উপমা- উৎপ্রেক্ষা আর চিত্রকল্পের সমন্বয় নির্মাণ করেন তার কবিতার আয়তক্ষেত্র, সুনিপুণ শব্দ চয়ন, ছন্দের দোলা ও প্রতীকের আশ্রয়ে কবিতায় যোগ হয় একটি ভিন্নমাত্রা, তাছাড়া কবির মনোজগত থেকে উৎসারিত ভাবাবেগ রয়েছেই; সে অর্থে কবি ও গীতিকার মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান শতভাগ সার্থক। বিশেষ করে তাঁর গানে ও কবিতায় ইঙ্গিতময়তা বিশেষ ভাবে পরিলক্ষিত সেই সাথে তাঁর সাহসী উচ্চারণ কখনোই পরিমিতিবোধকে অতিক্রম করে নি, এখানেই তাঁর স্বকীয়তা।
সুপ্রিয় পাঠক, আরো একবার ঘুরে আসি ‘নির্বাচিত গান হৃদয়ের ধ্বনিগুলি’ গ্রন্থের ‘কত যে কথা জাগে’ [ অনুভব প্রাসঙ্গিক ভাবনা ] পর্ব থেকে।
অ. শেফালী নামের সেই মেয়ে
আঁচলে পড়ানো যার বাবা মা ও ছোট ভাই বোন
অভাবঅনটন
তার উপরে প্রেম এলো
বিধাতার এ কী প্রহসন।। [ পৃষ্ঠা-২৭৮ ]
আ. আজ ভোর বড় কান্না কান্না ভোর
সূর্য কি তার লুকিয়েছে মুখ লজ্জায়
সময়ের ঘারে সিন্দাবাদের বুড়ো
জং ধরে গেছে বুঝি তারও কল কব্জায়।। [ পৃষ্ঠা–৩২৫ ]
এবার না হয় দেখে নেবো ছয় ঋতুর বারো মাস [ ঋতুভিত্তিক ] পর্বে কবি কিভাবে ঋতুকে ধারণ করে নিয়েছেন। কবির কবিতায় উদ্ধৃতাংশঃ
অ. ঝঞ্ঝা নূপুর বাজিয়ে চরণে এসো
রৌদ্র- রুদ্র অগ্নিবরণে এসো
লক্ষ যুগের অলস তুন্দ্রা উড়িয়ে নাও
পুরনো পাতার জীর্ণ লেখন পুড়িয়ে দাও
নব চেতনায় নব বৈশাখ এসো।। [ পৃষ্ঠা–৩৪১ ]
আ. গ্রীষ্মে দগ্ধ হয়ে বর্ষায় ভিজে
শরতে শুভ্র কার মন
স্বর্ণ শোভিতা হ’য়ে হেমন্ত শেষে
জড়িয়ে শীতের গুণ্ঠন
বিরহিনী প্রতীক্ষায় যার অভিসারে
সেই বসন্ত এসেছে দুয়ারে।। [ পৃষ্ঠা–৩৯৩ ]
চরণে নূপুর পরে যেন বৈশাখ আসে। বৈশাখ যেন আসে অগ্নিরুপে প্রাচীন ঘুনে ধরা অলস সমাজ ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়ার আহ্বান করেছেন কবি। যা কিছু প্রাচীন সবকিছু গুড়িয়ে নতুন করে, নতুন রুপে বৈশাখ কে বরণ করতে চেয়েছেন তিনি। পাশাপাশি ঋতুরাজ বসন্তের আগমনে কবিমন আনন্দবন্যায় ভেসেছেন কিছুটা সময়, দুলেছেন প্রাণের দোলায় কেননা বসন্ত এসেছে দুয়ারে।
কবি ও গীতিকার মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানের কণ্ঠস্বর চিনে নিতে কষ্ট হবার কথা নয় কারণ তাঁর কাব্যভাষা।
তাঁর গানের অন্ত্যমিল, চিত্রকল্প এবং শব্দ চয়নে কবির মুন্সিয়ানার পরিচয় সুস্পষ্ট। এক দিকে প্রকৃতি, দেশ ও ভাষার প্রতি গভীর মমত্ববোধ, মানব- মানবীর হৃদয় ঘটিত প্রেমাপোখ্যানের পাশাপাশি সুফি বাউল তত্তের প্রতি একনিষ্ঠতা তাঁর কাব্য ভুবনকে সমৃদ্ধ করেছে এ কথা নিশিত করেই বলা যায়। কবি ও গীতিকার মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান এভাবেই তৈরী করেছেন তাঁর নিজস্ব কাব্যভুবন।
একান্তে তুমি আমি [ সুফি বাউলতত্ত্ব ] পর্বে স্রষ্টার অবাক সৃষ্টির কাছে কবি নতজানু। জিজ্ঞাসার যেনো শেষ নেই। হাজারো প্রশ্ন কবির। দেহের ময়লা ধুলেই যাবে কিন্তু মনের ময়লা? জন্ম- জন্মান্তর যাকে খুঁজছি সে কোথায়? কেবলমাত্র আত্মশুদ্ধির মাধ্যমেই স্রষ্টাকে চেনা যায়। দেখা যাক উদ্ধৃতাংশঃ
অ. দেহের কালি ধুলেই যাবে মনের কালির কি উপায়?
শাস্ত্র পায়ে শাস্ত্রী হাঁটেন
দেহ পাপের পঞ্জী ঘাঁটেন
দাড়াতে পারেন না তিনি নিজের বলে নিজ দু’পায়।। [ পৃস্থা-৪৯৯ ]
আ. এক আমারে ছিন্ন করি
কুল্বের উপর আয়না ধরি
চমকে দেখি কোন আমারে
জন্মান্তরে খুঁজলাম কারে
অবোধ জামান কি চাস প্রমাণ
ওয়াক্ত ফারাকের সীমানা কোথায়? [ পৃষ্ঠা-৫০৭ ]
কবি গীতিকবি মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানের ধ্বনিগুলি নিশ্চয়ই আমরা উপলব্ধি করাতে পেরেছি তাঁর কাব্য পাঠ শেষে। ইচ্ছে করেই ছায়াছবির গান গুলোর উদ্ধৃতি দেয়া হয় নি। ছায়াছবির গানের কথা বলতে গেলে ভিন্ন একটি নিবন্ধ রচনায় দাবী রাখে। কবি ও গীতিকার মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান তাঁর সৃষ্টির স্বীকৃতি স্বরূপ দেশে-বিদেশে নানাভাবে সন্মানিত হয়েছেন।ডেইলী স্টার-স্টান্ডার্ড প্রদত্ত আজীবন সম্মাননা (লাইফ টাইম এ্যাচিভমেন্টএ্যাওয়ার্ড – ২০১০), পাশাপাশি, বাচসাস পুরষ্কার, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার, চ্যানেল আই পুরষ্কার, চাঁদের হাট পুরষ্কার অন্যতম।
সামান্য পরিসরে অগ্রজ কবি ও গীতিকার প্রসঙ্গে বলার চাইতে না বলাই রয়ে গেল বেশী। কবি ও গীতিকার মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান লক্ষ লক্ষ পঙক্তিমালা রচনা করেছেন, তার স্মরনাযোগ্য একটি পঙক্তিই কাব্য খ্যাতির জন্য যথেষ্ট। এর প্রমাণও আছে। মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান কালজয়ী কয়েকটি পঙক্তির উদাহরণ তুলে ধরার লোভ সংবরন করতে পারছি না। এ যেন আকাশের বিশাল তারকারাজির অগুনতি তারার মাঝে দু’একটা তারার নাম বলা। যেমনঃ
১. আমি আকাশে লিখেছি সূর্যোদয়ের নাম
২. আমার বাউল মনের একতারাটা
৩. পাহাড়ের কান্না দেখে তোমরা তাকে ঝর্ণা বলো
৪. ও চাঁদ চুরি করে চোখ দিও না আমার বধূর মুখে
৫. দৃষ্টি দিয়ে লাভ কি বলো আমার মনের আয়নাতে
৬. তুমি দুঃখ চাষের আর কি কোন জায়গাই পেলে না
৭. তারায় তারায় অক্ষর গড়ে শব্দের খেলা খেলেছিলাম
৮. দেহের কালি ধুলেই যাবে মনের কালির কি উপায়
কবি ও গীতিকার মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানের গান ও কবিতার অন্তরালে একজন যাদুশিল্পীর যাদুর স্পর্শ অনুভব করা যায়। কবি তার যাদুর স্পর্শে মোহবিষ্ট করে রাখেন তার পাঠক ও শ্রোতাদের। এখানেই তার স্বকীয়তা; একাই একশো।
ভালো থাকেন কবি ও গীতিকার মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান শতায়ু হোন। আপনার জন্মদিনে রইলো ফুলের শুভেচ্ছা।
————————-
কবি ও প্রাবন্ধিক