শিহাব শাহরিয়ার। কবি, গবেষক, প্রাবন্ধিক, গাল্পিক, ভ্রমণলেখক, নাট্যকার, গীতিকার, সাহিত্য সমালোচক, স্ক্রিপ্ট রাইটার, উপস্থাপক। তিনি চার দশকেরও বেশি সময় ধরে লেখালেখি করছেন। কবিতা, গল্প, গবেষণা, প্রবন্ধ, স্মৃতিগদ্য, ভ্রমণ, সম্পাদনা ইত্যাদি মিলিয়ে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৩০টি।
২০০৫ সাল থেকে সম্পাদনা করছেন লোকনন্দন বিষয়ক পত্রিকা বৈঠা। বৈঠা’র বেরিয়েছে জ্যোৎস্না, বৃষ্টি, গ্রাম ও সমুদ্র সংখ্যা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স এবং এম. এ করেছেন। ২০১০ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পিএইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করেছেন। সাংবাদিকতা দিয়ে তিনি কর্মজীবন শুরু করলেও পরে সরকারি চাকরি শেষ করে বর্তমানে সার্বক্ষণিক লেখালেখি করছেন।
সাহিত্য উৎসব, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, বইমেলায় অংশগ্রহণ এবং ব্যক্তিগতভাবে তিনি ভ্রমণ করেছেনÑযুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, শ্রীলঙ্কা, বাহরাইন, কাতার, মালয়েশিয়া, জার্মানী, ফ্রান্স, চেক রিপাবলিক, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, ভুটান, আর্জেন্টিনা, চিলি, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কানাডা।
লেখালেখির জন্য ইতোমধ্যে দেশ-বিদেশ থেকে পেয়েছেন বেশ কয়েকটি পদক, পুরস্কার ও সম্মাননা।
জন্ম: ১৯৬৫, শেরপুর। তাঁর পিতা-মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, মা-সারা খাতুন, স্ত্রী শামীমা হক এবং দুই পুত্র প্রাচুর্য শাহরিয়ার ও সমৃদ্ধ শাহরিয়ার।
শিহাব শাহরিয়ারের কবিতা
তুমি যদি হাঁটো পিঁপড়ার পায়ে
একটি প্রজাপতি উড়েছিল আমার কানের পাশে
আমি তার পাখার ইশারায় – তোমার বুকের কাছে
রেখে দিয়েছিলাম আমার ইচ্ছা-শার্টের বোতামগুলো
আমি আজও ঋণি – জামগাছের ছায়ার কাছে
আমি এখনো বারবার সিন্ধুকের কাছে যাই
দেখি ওর কারুকাজ, মুখ-মায়া, মুখের উপমা
বাল্যবিবাহের অগ্নিজলে স্নান করেছে যে কিশোরী
আমি তার শাদা শাড়ির অংশ রেখে দিয়েছি সিন্ধুকে
তুমি যদি পিঁপড়ার পায়ে হেঁটে যাও মাইল মাইল
আমি পথ আগলে বলবÑ দিয়ে যাও আমার ইচ্ছেগুলো
ঘুমের বিন্যাস
গরম ভাতের ফেনের মতো
উড়িয়ে দাও তুমি ঘুমের বিন্যাস
এই যে মেঘেরা মেলেছে পাখা
এ শুধু ঘুম কাতর বৃষ্টির তোলপাড়
বৃষ্টিস্নাত কচুর শরীর হলুদ হলে
বৈরী সন্ধ্যায় কেবল বোঝা যায়
মাটিকাটা ভিটাবাড়ির রূপ-রং
অবদমনে বালিকার বেদনা হয়
যদি কেউ বোঝো ভ্রƒণের ঘূর্ণি-ঝড়
তবে কাক-জ্যোৎস্নায় বালিকাকে দিয়ো ঠাঁই
ভাত, ভিটা ও বালিকার জন্যে থাকুক বৃষ্টি-ঘুম
তোমার কাঠকয়লার জীবন
গোধূলিরাঙা নদীচরে যাবার প্রবল ইচ্ছায়
তুমি রৌদ্রের দিকে ছুড়ে দিলে স্বর্ণালি আংটি
বললে, নদী আর কাকের চোখে থাকে বিশ্বাস
আমার মনে হলো এই সকাল উত্তেজিত বুড়ি-সকাল
উত্তরণের উপায় খুঁজতে তুমি পেলে মেয়েলি-বিকেল
ঘরের খুঁটির জন্যে চলো আমরা কাঠ খুঁজতে যাই
নদীচরে সিঁড়ি বানাতে কড়ই কাঠের বড় প্রয়োজন
ছুড়ে দেয়া আংটির রং ভুলে গিয়ে তুমি হাত রাখলে কাঠকয়লায়
আমাদের নক্ষত্র
বৃষ্টির চোয়াল থেকে
জলরস পান করতে গিয়ে
মনে পড়ল আমরা একদিন
দÐকলস গাছের ছায়ায় বসেছিলাম
আমরা সেখানে সাজিয়েছিলাম পুতুলঘর
কতগুলো প্রহর কাটিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম
আমাদের হাতে থেকে পড়ে গিয়েছিল পিতলের কলসি
কতগুলো মৌমাছি উড়ে এসে আমাদের কানে তুলেছিল সুর
মৌমাছির কণ্ঠে তুমি কী খুঁজে পাও – বৃষ্টির সুর অথবা সুরের ব্যবধান?
তুমি আজ এক অন্ধ পিঁপড়া
পরাজিত তুমিও
যাচ্ছি বলে যাওয়া হয় না
এ আমার এক ধরনের পরাজয়
তুমি ছেড়ে গেছো আমাদের শহর
এই শহর আমাকে দিয়েছে ফুটপাত
অথচ আমি একাই হাঁটি সন্ধ্যার বড় সড়কে
এই সড়কে একদিন পড়ে থাকত
তোমার চুলের উকুন, ওড়নার ছেঁড়া অংশ
পড়ে থাকত উঁচু স্তনের মতো তোমার ঠোঁটাংশও
আমি যদি ভুল করে ফিরে যাই পুলপাড়ে
তুমি কি তার পরেও ভাসবে নাফ নদীতে
আমার যাওয়া না যাওয়া দিয়ে
জানিÑ তোমার কিছু যায়Ñ আসে না
যেহেতু তুমি আজ এক অন্ধ পিঁপড়া
শূন্যতার মাপকাঠি নেই
শূন্যতার কি মাপকাঠি আছে?
অথচ আমি বোকার মতো শূন্যতা মাপতে গিয়ে
আকাশের দড়ি ধরে রৌদ্রে খরতাপে পড়ে গেলাম
গাভির গলার দড়ির ভাব কেউ বোঝে কি?
আমি তবে কেন দড়ির ভাব খুঁজতে যাব?
একদিন বুঝেছিলাম নদ ও নদীর ব্যবধান
এই ব্যবধান পুরুষ ও নারীর কোমরের মতো
নারীর কোমল কোমর থেকে যখন খসে লাবণ্যরস
পুরুষের জিহ্বারসে ভিজে তখন ভাদ্রের ভ্যাপসা গরম
দালানের ভাষা
আমার তো কোনো দেনা নেই
আমি তবে কেন পেছন ফিরে দাঁড়াব
দাঁড়ালে যে তোমার মতো দু’চোখ হারাব
সড়কের বাতিরা নিভে গেলেই
স্বরের পাখিরা জেগে ওঠে ভোরের চোখে
উঁকি দেয় আলো দালানের ফাঁকে ফাঁকে
ও দালান তোমার গায়ে ইট-সুরকির বালাই নেই
আমার দালানের ভাষা বুঝে গেছে আলোরা আগেই
অন্তর্জাল
আমি এক ব্যাকুল বালক
অসংখ্য দুপুর দৌড়িয়েছি
চড়–ইয়ের বাদামি পাখার পেছনে
সেই কৈশোরে দিয়েছি পাখার পরীক্ষা
তুমি ছিলে অন্তর্মুখী নারী
মাড়াওনি চৌচালা-ঘর-চৌকাঠ
ভাবি, যদি অন্তর্জাল থাকত তখন
তাহলে তুমি ঢুকে যেতে ঘর থেকে মনঘরে
তুমি তো পুরোনো মনঘরেই রেখেছে বেঁধে মন
এখনকার মনগুলো জড়িয়ে গেছে অন্তর্জালের জালে
প্রেমের দানা কুড়াতে এখন আর লাগে না বনেদি প্রশিক্ষণ
এক রাত অন্ধকার
রবি ঠাকুরের শিলাইদহ থেকে
আমি একটি রাত কিনেছিলাম
কুঠির পাশে পেতেছিলাম একটি দ্বিতল ঘর
সেই এক অন্ধকার নির্ঘুম রাতে – আমি একা
একা খেলেছি অদৃশ্য ইঁদুর বিড়াল আর বাদুড়ের সাথে
ডিমলাইটের ভেতর ভয় ভয় খেলায় আমার সঙ্গে মেতেছিল মশারি
অবশেষে ছোপ ছোপ ছোপ ছোপ রক্তে ভেসে গেছে মোজাইক করা মেঝে
তুমি কি বোঝো নির্জন নির্ঘুম এক অন্ধকারে একটি রাত কী ভয়াবহ হয়ে ওঠে?
টিনঘর
বৃষ্টিরা খেলুক তোমার বুকের ভেতর
ও টিনঘর, তুমি বাজাও তোমার সুর
তোমার স্বরের ভেতর বেঁধে দাও আমার বুক
ধুক ধুক উঠুক আওয়াজ, বাজুক নৃত্যের নূপুর
পাড়ের ভাঙন দেখে আমিও খাসজমি খুঁজেছিলাম
বনজ বৃক্ষের গন্ধ নিয়ে আমিও নারীর বেদনা বুঝেছিলাম
ও নারী, তুমি মুখর বৃষ্টিতে ভিজে মাদকতা ছড়িয়ে দাও মনে
’কোমেন’ দুর্বল হলেও ডুবে গেছে অসংখ্য টিনঘর, ঘাসঘর, মনঘর