আড্ডাপত্র

৬ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১; ২১ নভেম্বর, ২০২৪;বিকাল ৪:২০

গণঅভ্যুত্থানের কবিতা : পর্ব ৯

আড্ডাপত্র

অক্টো ২৪, ২০২৪ | কবিতা, গুচ্ছ কবিতা

সময়টা দ্রোহের। সময়টা তারুণ্যভরা শ্লোগানের। একঝাঁক তরুণের ফুঁসফুঁস ভরা বিদ্রোহী বাতাস। মুখ গহবর থেকে বের হওয়া ধ্বনি কাঁপিয়ে দেয় শাসকের মসনদ। নিঃশ্বাসের ঝড়ো বাতাসে নিভিয়ে দেয় দুঃশাসনের বাতি। চোখের চাহনিতে উল্কার হল্কা। বুকের ভিতরে বসবাস সাহসের রাজহাঁস। শ্লোগানের শব্দকোরাস সাঁতার কাটে রাজপথে। দ্রোহের জলোশ্বাস ছড়িয়ে পড়ে শহর থেকে গ্রাম-গঞ্জে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্কুল- কলেজ-মাদ্রাসায়। ভেদাভেদ ভুলে যায় কে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। কে কওমী কে আলিয়া। কে ধনির দুলাল কে কৃষকের সন্তান। প্রত্যেকেই মুক্তপ্রাণ তরুণ। তরতাজা কিশোর-যুবকের হুঙ্কারে কেঁপে ওঠে অত্যাচারী শাসকের দেড় দশকের গদি। পতন হয় এক স্বৈরশাষকের।
ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে হাজার তরুণ-তাজা প্রাণের ঝরে যায়। রক্তের ভিতর জেগে ওঠে মানবমুক্তি। জুলাই ২০২৪ এর ছাত্র-গণআন্দোলেনর এই বীরত্বগাথাকে দেশপ্রেমী-বিপ্লবী কবিগণ তুলে ধরেছেন তাদের কবিতায়। কবিতার সেইসব দ্রোহীপঙক্তি আড্ডাপত্র ধারাবাহিকভাবে মেলে ধরছে পাঠকের সামনে। আজ প্রকাশিত হলো ‘গণঅভ্যুত্থানের কবিতা’ ৯ম পর্ব। লিখেছেন কবি শাহীন রেজা , কবি আবু জুবায়ের ,কবি মীম মিজান ,কবি উম্মুল খায়ের ও কবি জাবির জাহিদ।

ইয়ামিন, প্রিয়পুত্র আমার

শাহীন রেজা

এপিসি’র উপর থেকে নিথর দেহটা যখন ধানের বস্তার মত টেনে হিঁচড়ে ফেলে দেয়া হলো তখনও তোমার দেহে প্রাণ ছিলো। তুমি ঠোঁট নাড়ছিলে একফোঁটা পানির জন্য। হে আমার সন্তান, কী ব্যর্থ পিতা আমি, মৃত্যুর নির্মমতায় ছটফট তোমার মুখে তুলে দিতে পারিনি এক বিন্দুটুকুও। ইয়ামিন, প্রিয়পুত্র আমার, ক্ষমা করে দিও। কমফোর্টারের ভিতরে শীতঘুমে আচ্ছন্ন আমরা বুঝতেই পারিনি আমাদের সন্তানেরা তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য কি ভাবে পেতে দিচ্ছে বুক বুলেটের সামনে। না তখন তো রাত নয় রৌদ্র করোজ্জ্বল দিন শাসন করছে পৃথিবী, পাখি উড়ছে, ফুলে ফুলে প্রজাপতি, রক্তের ঘ্রাণ শুকে শুকে একদল মৌপিঁপড়া গোয়েন্দার মত হানা দিচ্ছে মৃতদেহের পাশে।

প্রিয়পুত্র, আমরা তোমাকে বেঁধে রাখতে পারিনি, দিতে পারিনি সুন্দর এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা। যে বৈষম্যের তীব্র ছোবল তোমাদের হৃদয়কে রক্তাক্ত করেছিল, সেই ছোবলের পেছনে লুকিয়ে থাকা রক্তলোভী হায়েনারা আরও রক্তাক্ত করে অন্যদের মত তোমাকেও কেড়ে নিলো চূড়ান্ত ভাবে। না আমি আর কাঁদবোনা। প্রিয়তম পুত্রের জন্য অশ্রুকে অস্ত্র বানিয়ে তাক করবো ফ্যাসিবাদী ওদের দিকে। আমাদের ঘৃণায় নিশ্চিত ধ্বংস হবে ওরা, ওদের প্রেতাত্মারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে পৃথিবী থেকে।

বিপ্লবের ছায়ায় তোমার পা

আবু জুবায়ের

বিপ্লবের ছায়া পড়েছিল আমাদের দোরগোড়ায়
কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমরা দাঁড়িয়েছিলাম,
ভেবেছিলাম এইবার সূর্য উঠবে নতুন আলো নিয়ে,
কিন্তু সে আলো ছিল চোখ ধাঁধানো
যেখানে আমাদের দৃষ্টি হারিয়ে গেল,
পথ হারাল বিপ্লবের শপথ।
বিপ্লব যদি ভুল পথে চলে
তা কেবল বারুদের গন্ধ নিয়ে আসে,
কঠিন দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে মুচড়ে যায় স্বপ্ন
রাস্তাগুলো ভরে ওঠে প্রতিশ্রুতির ফাঁদে।
তুমি কি দেখেছিলে সেই মুখগুলো
যারা একসময় আমাদের সাথেই হাঁটত?
আজ তারা মুখোশের আড়ালে হাসছে,
বিপ্লব এখন তাদের হাতের খেলনা
ক্ষমতার পালাবদল ছাড়া আর কিছুই নয়।
সেই আগুন কি নিভে গেছে?
নাকি আমরা ভুল পথে হাঁটছি,
যেখানে বিপ্লব মানে স্রেফ এক শ্লোগান,
মানুষের কণ্ঠে উঠে আসা হাহাকার
গুম হয়ে গেছে বন্দুকের আওয়াজে?
বিপ্লব যদি সত্যি ভুল পথে যায়,
তবে রক্তে লেখা ইতিহাস মুছে যাবে একদিন।
তোমার আমার শরীরের ভাঁজে ভাঁজে
থেকে যাবে ক্ষতের দাগ,
তুমি কি জানো,
আমরা আজও অপেক্ষায় আছি
সেই সত্যিকারের বিপ্লবের,
যা মানুষের মুক্তির গান গাইবে
রক্ত নয়, হবে ভালোবাসার স্রোত,
প্রতিটি মাটির টুকরোয় লেখা থাকবে
স্বাধীনতার নাম, বিপ্লব জিন্দাবাদ।

২১ অক্টোবর , ২০২৪ , প্যারিস , ফ্রান্স

অন্ধকারের হন্তারক

মীম মিজান

কে সেই অন্ধকারে হন্তারক
জোনাকি বা কবুতরগুলোকে মেরে ফেলছো
কিংবা দূর আকাশ থেকে এসে
চকচকে সাগর বুক থেকে ছিনিয়ে
নিয়ে যাও সৌন্দর্যের প্রতীক কোনো রঙিন মাছকে

ওরা কি ফিলিস্তিনি
বা আফগানি কিংবা ইউক্রেনের শত্রু
অথবা কাশ্মিরের সন্তান

তবে কি তুমি ইসরাইলি বা মার্কিন সৈন্য
বা ভারতের পাষাণ মোদিপুত্ররূপী সৈন্য
যারা মানবিকতায় নিদারুণ খাটো, দৈন্য

তিয়েন আনমেন স্কয়ারের জঘন্য স্মৃতি
আজ ভেসে ওঠে আমাদের সবার চোখে

২৬ জুলাই, ২০২৪

গ্রাফিতি

উম্মুল খায়ের

পাষাণ তো নই,হৃদয়টা তাই খুলেই রেখেছি
মিছিলে মিছিলে সয়লাব সব অলিগলি, ঘাট
চারদিকে শুধু গুলির শব্দ!
বাতাসে ঝাঁঝালো বারুদ -গন্ধ ; অসহায় লাগে
রাজপথ আজ রক্তের নদী! রাত জেগে আছি
আমার তো ঘুম আসে না, দু’চোখে বেদনার ঢেউ।

মাটির কান্না শুনতে শুনতে পাথর হয়েছি
বোবা কান্নায় গুমোট থেকেছি পুরোটা জুলাই
এতোগুলা তাজা প্রাণ হারিয়ে গেল চিরতরে
মেঘের ডানায় চেপে উড়ে গেল দূরের আকাশে
তাদের গল্প থেকে গেল সব হৃদয়ে হৃদয়ে।

সাহসের সাথে যাঁরা বুক পেতে দিয়েছে গুলিতে
তাঁরাই মহান,অমর শহীদ।
শিল্পী নই তো,তবুও তাঁদের ছবি আঁকি মনে
মনের দেয়াল জুড়ে মুখ আঁকি হাজার হাজার
সময়ে সময়ে ছুঁয়ে দেখি সেই সব শহীদের গ্রাফিতিগুলো।

গুলি

জাবির জাহিদ

কতোটা অন্যায় আর অবিচার সয়বার পর
একটি ছেলে মৃত্যুর ভয়কে উপেক্ষা করে
উত্তপ্ত শোণিত রাজপথে নামতে পারে!
কতোটা অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার পর
একটি ছেলে বুক চিতিয়ে বন্ধুকের সম্মুখে
দুহস্ত প্রসস্থ করে দাঁড়াতে পারে!
কতোটা সাহস আর জোর থাকার পর
একটি ছেলে একের পর এক বুকে গুলি
খেয়েও আবার দাঁড়াতে উদ্যোত হয়!
কতোটা ক্ষোভ আর সীমাহীন আক্ষেপ নিয়ে
একটি ছেলেকে চিরকালের জন্য পৃথিবীর
মায়া ত্যাগ করে পরপারে চলে যেতে হয়!
কতোটা পাষাণ আর সীমার হলে পরে
একটি সাহসী ছেলের বিশ্বাসের বুকে গোটা
কয়েক গুলি ছুড়ে রক্ত ঝরাতে পারে!
কতোটা নিষ্ঠুর আর নিদয় হলে পরে
মায়ের বুক খালি করে দিতে পারে!

Facebook Comments

আড্ডাপত্রে লাইক দিন

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১১৩১৫১৬
১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭৩০