আড্ডাপত্র

২৩ মাঘ, ১৪৩১; ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫;রাত ১২:৫৮

গণঅভ্যুত্থানের কবিতা : পর্ব ২১

আড্ডাপত্র

ফেব্রু ১, ২০২৫ | কবিতা, গুচ্ছ কবিতা

কাবেদুল ইসলাম

আমি এখন কোথায় যাবো?

মাগো,
তোমার ছেলে মরেছে তাই আমি দেখো
আজ সারাদিন রোজা আছি
তোমার ছেলের শাদা শার্টরা রক্তে যারা লাল করেছে
গুলি ছুঁড়ে
তাদের ওপর নেমে আসুক খোদার কহর।

তোমার ছেলের বুকটা যারা ঝাঁজরা করে দিলো পথে
দিন-দুপুরে
রক্ত-হোলির আবীর মাখা এমন আকাশ
আর কখনো
দেখেছে কে, বলো, মাগো?

দোষ কী ছিলো অত্তটুকুন কচি ছেলের?
সবেই তো সে যাচ্ছিলো রোজ ভার্সিটিতে
না হয় একটা দাবিই নিয়ে হাঁটছিলো সব বন্ধু মিলে
যেমনটা যায় ওরা সবাই খেলার মাঠে রোজ বিকেলে
সড়ক বিভাজনের কাছে আসতে দেখো
বুকে কেমন গুলি খেলো!

অত্তটুকুন তরুণ প্রাণে সইবে কেন গুলির আঘাত!
তরতাজা খুন দেখো কেমন ভিজিয়েছে পিচঢালা পথ
এ কেমন দিন সূর‌্যটা ঐ পুব আকাশের
পথ পেরোনোর আগেই এলো রাত্রি নেমে!

ওয়ারড্রবে নিথর কেমন পড়ে আছে দেখো, মাগো,
গত ঈদে কেনা খোকার রঙিন দামি পোশাকগুলো
(একবারই যা পরেছিলো)
আসছে বছর বায়না কে আর ধরবে তোমার গলা ধরে
নতুন জামা কেনাকাটির?
খোকন তো নেই, সেই যে গেছে মিছিলে সে,
আর ফেরেনি

বই-খাতাতে ভর্তি ছিলো ব্যাগটা পিঠে
ছররা গুলির টুকরোগুলো আজও কেমন
আটকে আছে ব্যাগের গায়ে
সঙ্গে জমাট রক্তেরও দাগ ঝরেছিলো হৃদয় থেকে
দেখলে তোমার মনে হবে
এ তো আমার সেই পতাকা একাত্তরের
হায়েনারা গুলির ঘায়ে করেছিলো রক্তে যা লাল

আজকে আবার সে দিন কী, মা,
ফিরে এলো নতুন করে এই বাংলায়?
আবার কেন অস্ত্র হাতে তুলে নিতে হবে আমায়
ভাইকে আমার, বোনকে আমার বাঁচাতে, মা?

এ কোন্ কালো অমানিশা এলো নেমে চতুর্দিকে
উড়ছে শকুন মাথার ওপর বিকট ডানায়

আমি এখন কোথায় যাবো, বলো, মাগো?
জমা দেওয়া অস্ত্রগুলো চাইবো ফেরত
সামনে যখন অপেক্ষাতে একটা নতুন মুক্তিযুদ্ধ
ডাক এসেছে ঘর থেকে সব বেরিয়ে পড়ার…

আইউব সৈয়দ

ছত্রিশ জুলাই

সূর্য্যরে রশ্মির মতো- বুদ্ধিদীপ্ত অনন্য বিস্ময় রঞ্জিত-
যেন স্বতন্ত্র সুরেতে- জীবনপ্রণালি পথে আদর্শ রয়েছে ,
উল্লাস জাগা প্রতীক্ষা- তত্ত্বের মিশ্রণে আহা এনেছে জয়-
যেন রৌদ্রমাখা স্বপ্ন- অপার মহিমাতে বিবেচিত হয়েছে।

প্রক্রিয়ার জিজ্ঞাসাতে- সাক্ষ্য দেয় ব্যক্তিত্বের নৈপুণ্য হাঁক ,
যেন ছত্রিশ জুলাই- সাজিয়েছে ঐ রক্তাক্ত সত্যের বাঁক।

আশরাফ আল দীন

আগস্ট চব্বিশের প্রশ্ন

অপলক চেয়ে থাকি আকাশের দিকে, আর
দীর্ঘশ্বাসের মোড়কে একটি প্রশ্ন আমাকে
করাতের মতো কাটে,
বারবার কাটে!
বিপর্যস্ত অর্থনীতি আর লুটেরাদের
রেখে যাওয়া ২৪-এর বিধ্বস্ত বাংলাদেশে
আমার মতো লাখো হৃদয়ে
একটি প্রশ্ন বেদনার নীল রঙে ডোবে আর ভাসে!
: কী অপরাধ করেছিলাম আমরা!
যে তুমি ও তোমার কন্যা মিলে এতটা ভয়ংকর নির্মমতায়
দানবীয় কষ্ট দেবে পুরোটা জাতিকে?

এদেশের সহজ সরল মানুষগুলো বড্ড ভালোবেসে
অনিঃশেষ আন্তরিকতায় তোমাকে ডেকেছিলো
‘বঙ্গবন্ধু’ বলে;
কিন্তু হায় কেমন দুর্ভাগ্য বলো!
তুমি ভীষণ বদলে গেলে মসনদে বসে,
সীমাহীন ক্ষমতার লোভ আর একরোখা দম্ভে অন্ধ হয়ে
অসংখ্য মানুষকে বিনা বিচারে খুন করলে,
এবং লুটপাটের জোয়ারে ভাসিয়ে
দেশটাকে ঠেলে দিলে দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাসে!
নিদারুণ ক্ষুধার কষ্টে ও নীল যন্ত্রণায় ধুঁকে ধুঁকে
মানুষ মরলো পথে ঘাটে, লাখে লাখে!
অথচ তুমিও জানতে ভূখা জনতার খাবারগুলো
লুট করছিলো তোমার দলবল
রেখেছিলো গুদামজাত করে,
করছিলো বিদেশে পাচার
অবৈধ সম্পদের লোভে।
খোলা চোখে অসহায় তাকিয়ে আকাশের দিকে,
ওরা আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানিয়েছিলো
শেষ নিশ্বাস ফেলার আগে!

সেই আর্জির রুদ্র রোষে,
অগণিত মানুষের দীর্ঘশ্বাসের হলকায়,
সপরিবারে ধ্বংস হলে তুমি!
পুরো জাতির রাহু-মূক্তির উদযাপনের ভেতর
তোমারই আপন একজন বলে ফেললোঃ
ফেরাউনের পতন হয়েছে!

এরপরও সুখ নেই এই দুর্ভাগা জাতির!
তোমার কন্যা এসে গণতন্ত্রকে স্বাধীনতার কফিনে ভরে
বত্রিশ হাত মাটির নিচে দাফন করলো, আর
অকাতরে খুন করলো হাজার হাজার ছাত্র-জনতাকে!
গুম হওয়া ও হামলা-মামলায় নির্যাতিত মানুষের
অসহায় দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে উঠেছিলো এদেশের বাতাস,
অথচ তোমার কন্যা হয়ে উঠেছিলো ভীষণ
প্রতিশোধ প্রবণ!
মুক্তির জন্য মরিয়া মানুষ
দলে দলে ঘর ছেড়ে রাজপথ বেছে নিলে
পালিয়ে গেলো তোমার কন্যা; ছি!

মানুষ বললো এটাই তাদের রাহু মুক্তি,
এটাই তাদের আরেক স্বাধীনতা!
কিন্তু প্রশ্ন তো একটাইঃ
কী অপরাধ করেছিলাম আমরা!
তোমরা পিতা-পুত্রী মিলে এভাবে
আমাদের অবারিত ভালোবাসার সুযোগ নিয়ে
দানব-দানবী হয়ে উঠেছিলে কেন বলো তো?

অনিরুদ্ধ আলম

তুমিও একটি মিছিল

মেয়ে, তুমি এক তীব্র মিছিল ক্ষণে
তুমুল অথই বিজয়-আন্দোলনে।
মুগ্ধরা এসে যাবে না তো ফিরে আর
হৃদয় কাঁপুক জীবনের মন্থনে।

দীপ্ত কিশোরী বজ্রকণ্ঠে আজ
তুলে নিলো ঝড়ো বারুদের কারুকাজ।
কত-শত আবু সাঈদ এ-বাংলার
প্রহরী হয়েছে উচ্ছল জাগরণে।

অগ্নিকন্যা রুখে দিলো সন্ত্রাস
শিকল ছেঁড়ার গানে বাজে উচ্ছ্বাস।
ভালো থেকো খুব ও-পাড়েই আবরার
মেতেছে জোয়ার সবুজের যৌবনে।

তুখোড়-দামাল তরুণ-তরুণী যত
প্রতিরোধ গড়ে রাজপথে অবিরত।
ধ্বংসে পতিত দাঁতাল স্বৈরাচার
মহাকাল জাগে মুক্তির আলোড়নে!

এমরান কবির

গণকবরে

জলের ভেতরে জলের আঁধার, তার ভেতরে বারুদের ছায়া। মাটির উপরে কালো কালো চোখ, তার ভেতরে ছাইরঙা নগ্ন নখর। এই সব দেখা যায়, যায় না। গভীর রাতে একজন জোসনা, একজন গাছ, একজন পাতা, একজন বাতাস পরশ বুলায় ওই জলের ভেতরে, ওই মাটির উপরে।
কে আছেন ওখানে, কারা আছেন ওখানে! দিঘিতে জলের ছায়া দীর্ঘতর হচ্ছে। সংশয়ী ডানা নিয়ে আমি উড়ে যাচ্ছি টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া। বৃষ্টির ভেতরে আমি বাতাস হয়েও ভূগোলে ভূগোলে ছড়িয়ে যাচ্ছি, আর তাহাদের স্বজনেরা পেয়ে যাচ্ছে মিথ্যাময় প্রজাপতি। কিন্তু তুমি কোথাও নেই। তোমরা কোথাও নেই। তুমিই বলছো সে-কথা। কিন্তু কেন!
পতনের ভেতর থেকে আমি ঠিকই দেখেছি ভোর ও সন্ধ্যা। প্রতিমার চোখে দেখেছি তোমাদের গোপন ইশারা, যে স্বাতী কখনো নেভে না তার অভিধানে দেখেছি তোমাদের অভিমান। এখন বলো, তুমি কোথায় নেই? কাঁচের শহর ভেঙে যাচ্ছে সভ্যতার পতনের মতো। গড়ে উঠছে নতুন নতুন কাচ। শিকড়গুলো ছড়িয়ে যাচ্ছে ভূগর্ভ থেকে ভূগর্ভে। এভাবে… একদিন…
সবগুলো গণকবর থেকে গণবৃক্ষের শিকড় ছেয়ে যাচ্ছে পালক থেকে পালকে, সূর্যোদয় থেকে সূর্যোদয়ে, সূর্যাস্ত থেকে সূর্যাস্তে। আমরা যারা নিঃসঙ্গ তারা সমূহ নিহিতার্থ নিয়ে দেখছি তাঁদের ছড়িয়ে পড়া নিঃশ্বাস। ওই নিঃশ্বাস থেকে দেখো সকল মানব ও উপমানব একসাথে গেয়ে উঠছে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো নিয়ত স্বাধীনতার গান।
জলের উপরে, মাটির উপরে, সকল শূন্যে শূন্যে আলোছায়ার গোপন ইশতেহার- নেই, কিন্তু আছি- সমূহে সমূহে ধূলিকণায়

Facebook Comments

আড্ডাপত্রে লাইক দিন

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১১৩১৫
১৬১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭