জলেস্থলে ঈশ্বর
দূরে গিয়ে তুমিও দেখেছ ডুবে মর্মপ্রকৌশল–
সন্তরণ ভুলে যাওয়া মাছেদের অশেষ চক্কর,
পাখিদের ওড়াউড়ি ধার করে যতবার গিয়েছ উড়ে যন্ত্রপাখা বুকে
আকাশ তেমনি উদাসীন, আকাশের প্রান্তজড়ি তেমনি অসীম।
সম্ভব দৃশ্যের দিকে বাতাসের দৃপ্ত চলাফেরা, বাঘমুখ নিয়ে নিয়ে ঘুরেছে মানুষ
জঙ্গলের বধিরতা খুব কাছে জেনে, জঙ্গলের প্রকৌশল খুব কাছে নিয়ে
দেখেছে আয়না শুধু মর্মরের প্রতিচ্ছবি ধরে, মর্মরিত সকল ফ্রেমে বস্তু কিছু নেই।
ঘুরে গিয়ে তুমিও দেখেছ উড়ে দৃশ্যপ্রকাশন–
উড্ডয়ন ভুলে যাওয়া পাখিদের বিলাপ ঘূর্ণন,
মাছেদের স্বচ্ছভ্রমণ ধার করে যতবার গিয়েছ ঘুরে জলবসতির ধারে
সমুদ্র তেমনি চঞ্চল, অচঞ্চল চোরাগুপ্তা পাহাড়ের মুখ।
দৃশ্যমান স্রোত নিয়ে নদীদের সংক্ষিপ্ত চলাফেরা, চন্দ্রমুখোশ নিয়ে ঘুরেছে মানুষ
মানবীর বধিরতা খুব কাছে জেনে, মানবীর সুকৌশল খুব কাছে নিয়ে
দেখেছে হৃদয়ে শুধু বহিঃস্থের সুরধ্বনি শোনে, গুঞ্জরিত সকল প্রেমে বস্তু কিছু নেই!
দুই.
জঙ্গলের দিকে যেতে যেতে পাখনা ও পালক পুড়িয়ে ফেলি
গোঁ-ধরে উঠে যায় তাবৎ জমিন আকাশপৈঠায় পিঠ পেতে শোয়
অন্য কারো ডাকনাম ধরে কে যে দিবানিশি ডাকে।
এখানে ভ্রমণ কেন? ভ্রমহরি চিত্রার্পিত চায়,
গোবিন্দ গোঁয়ার তাকে পর্যাপ্ত থামাতে গিয়ে
তর্ক বেঁধে যায়; কে এই রাস্তার ফিতা খুলে বেঁধে রাখে বনের কুন্তলে?
মতিভ্রম, তাকে বলি হরিণবসতি, বলি হরিণীর পিছু-পিছু ধাওয়া।
যেভাবে সংখ্যাতীর শঙ্খ নদীর তীর ধরে ছোটে
হেঁটে হেঁটে নাভিতে জিরোই, অজস্র অদৃশ্য চোখ খুলে রেখে
শাসনের নিচে তাকে তেমনি শোয়াই, আকাশের অবাক দেরাজে
যেমন বিস্তারিত মেঘপল্লব, ক’প্রস্থ জঙ্গল খুলে হঠাৎ দেখেছি
কল্লোলিত ঢেউ নিয়ে তবু শান্ত বহুনিম্নের পায়রা নদীটি।
তিন.
শান্ত এক সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে পুনর্বার অশান্ত হয়ে উঠি
যে বিক্ষুব্ধতা সমুদ্রের ভেতরে লুকানো সে কেন লাফিয়ে উঠে মানুষ ভেজায়?
মানুষ ডিঙাতে গিয়ে বহুবার ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ সমুদ্র হেরেছে।
যে দুর্লঙ্ঘ্য পাড়ি মানুষের ভেতরে নির্মিত, সে কেন লাফিয়ে উঠে সমুদ্রে বেড়ায়
অসম্ভব সব জলসীমা পাড়ি দিতে মানুষ ছেড়েছে সুস্থতীরভূমি, প্রিয়তমা বন্দর
তীরের মতন তার ইচ্ছা গেছে বাতাসের প্রতিকূলে ব্যবধান কেটে কেটে
ধনুকের মত বেঁকে থাকা ইচ্ছাপ্রবল ঐ পালের শরীর, ফুলে থাকা–
মানুষ একান্ত পারে প্রগলভ শব্দদের বাঁশি করে সমুদ্রে বাজাতে
পিয়ানো ভরেছে যে ঢেউ থেকে তুলে আনা অজস্র জলজ সিম্ফনি।
অন্ধ এক সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে পুনর্বার চক্ষুষ্মান হয়ে উঠি
যে বিপন্নতা সমুদ্রের ভেতর লুকানো সে কেন তীরে এসে মানুষ কাঁদায়?
চার.
গভীর সমুদ্রে গিয়ে এতখানি খোলামেলা পাওয়া গেল তোমাকে আকাশ
আশাবরী সমস্ত পালের আড়াল ছেড়ে নৃত্যপর তুমি বিবসনা
ঘূর্ণিময় উচ্ছ্বাসের প্রান্তে গিয়ে ঘাগরা উড়িয়েছ
গভীর নীলের কাছে মানুষের মর্মপাঠোদ্ধার
প্রপিতামহ মাছেদের আশ্চর্য পাঠশালা
প্রণয়ী সকল মাছ ছেড়ে গেছে সুপ্ত-লীলাখেলা।
সুউচ্চ আকাশে গিয়ে এতখানি খোলামেলা পাওয়া গেল তোমাকে সাগর
দূরবর্তী সমস্ত মেঘ মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে নিত্য করে চলাফেরা
প্রাণবান দিগন্তের প্রান্তে গিয়ে লুপ্ত-হাহাকার
প্রমাতামহ পরীদের অপূর্ব স্নানাগার
প্রণম্য সকল পাখি ছেড়ে গেছে লুপ্ত লজ্জাব্রীড়া।
পাঁচ.
অনেক পোড়ানো হল বনভূমি, অনেক নদীর পিঠ বেঁধে দেয়া হল সেতুতে
অনেক পর্বতের মাথা কেটে বসানো হল সমতলের ঘ্রাণময় বুকের গভীরে
ক্ষতস্থানে তাতে খুব তীব্র সারেনি, ব্যথা সরে গেছে দূরে ব্রীজের কোমরে
অনেক শাসন করা হল নদী, অনেক স্থবির চাল উড়ে গেল ঝড়ে, ঝড়ের ঋতুতে।
ছয়.
ফিরে আসছে গৃহত্যাগী জল স্রোতের আবর্তে ঘূর্ণি খেতে ফের
ফিরে আসছে রেলিঙের উপর ভর রেখে তাকানো রাত আমাকে কাঁদাতে ফের
সেই সুপ্ত পরাজয় ফিরে আসছে, মিহিলতা ফিরে এসে আমাকে জড়িও
তারও আগে সকল প্রোথিত চুম্বন প্রিয় শরীর ছিঁড়ে ফিরে আসছে ঠোঁটে
ঠেলে দিচ্ছে বিস্বাদ, অতীতের গন্ধঠাঁসা আকুল বকুল।
ফিরে আসছে স্থানচ্যুত মাঠ প্রান্তরের প্রকাশ্যে বেআব্রু হতে ফের
ফিরে আসছে উপড়ে ফেলা গাছ, ডালপালা, পাখির কূজনসহ বসে যাচ্ছে ভূমিবর্গের পর
ফিরে আসছে পাহাড়ে পাহাড়ে কাটানো দিন আমাকে ডোবাতে ফের
সেই লুপ্ত আবেগ ফিরে আসছে, মিহিলতা ফিরে এসে আমাকে জড়িও
তারও আগে সকল প্রেরিত চিঠি ডাকবাক্স ছেড়ে ফিরে আসছে নিবের ফলায়
ছড়িয়ে দিচ্ছে বিষাদ, কলমের প্রাণভরানো যত আকুল বকুল।
সাত.
ভুলে যাওয়া ভ্রমণ আমার…
পৃথিবীর নদীদের সঙ্গে ভেসে এসে
মহাকাশে আকাশগঙ্গার পথে কবে যে ছেড়েছি
প্রিয় মানুষের মুখের বন্দর, আলোঝলোমলো মুখ
এলোমেলো দীর্ঘ পায়ে পায়ে পাহাড়ের শিরদাঁড়া বেয়ে
হঠাৎই উড়াল এই কন্যার কোলে, সূর্য যার দুধশিশু।
ভুলে যাওয়া পৃথিবী আমার…
Facebook Comments