মুসা আল হাফিজ এর কবিতা
ঈভের হ্রদের মাছ
হে চন্দ্র! তোমাকে হ্রদ দেখাবো—
তাতে বেদনার কলজেছেঁচা রক্ত
তৃষ্ণার তাণ্ডবে দাউ দাউ করে জ্বলছে !
তুমিতো লাবণ্যের মুখ, পূর্ণমানুষ নও
তবু তোমাকে আজ বুকের হ্রদ দেখাবো।
গোলাপের সুরভিকে
তুঙ্গউচ্ছ্বাস দিলো যার লবণাক্ত ঢেউ
সত্যের চাদর তাকে বিশ্বাসের মন্ত্রে ঢেকে রাখে!
কখনো দোয়েলের শিসে নড়ে ওঠে
বাতাসের যুক্তিতে
দুলে ওঠে জলরাশি;
সে তো আমারই বিগলিত বিস্তার
প্রাচীরের আড়াল থেকে কেউ যাকে
নাম দিয়েছিলো সভ্যতা!
এই যে পৃথিবী, সবুজ স্বাস্থ্যের নরোম
সোচ্চার সুগন্ধি আর
জাকালো বৃক্ষের তন্ময়তা
সবই তো নিষ্করুণ, নিস্প্রাণ
চিলের পালক।
শুধু এক প্রেমিক বিহঙ্গ, ঠোটে যার
ঐশ্বর্যের গরিমা উছল!
সারাদিন হাওয়া আর
জাফরানি রোদের পোশাক
সারারাত মসলার ঘ্রাণ
এরই নাম স্বর্গের উজানে
থরথর করে ছুটা
পৃথিবীর শৈশব?
বিহঙ্গ! বিহঙ্গ! তুমি অদেখা অধীর
কোথায় গুপ্ত তুমি
সুবিমল কোন সবুজে?
আমার বন্ধ্যামাঠে তোমার আওয়াজ
শুধু অস্তিত্বের রক্তে তুলে
ললিত স্পন্দন।
এসো এসো
তৃষ্ণার স্তবকে
তোমাকে ছুঁয়েছে সেই স্বর্গচ্যুত প্রেম নিশ্চয়
দাউ তার সুরভি মাতাল।
আমি কতো দীর্ঘশ্বাসে পৃথিবী কাপাই
অশ্রুধারায় ভাসাই প্রান্তর।
ফলত পেয়েছি শুভ্র সাঁতারু সভ্যতা
প্রতিশ্রুতির তিনটি হরফ!
তাকেই রেখেছি জিইয়ে হ্রদের অতলে
সে পৌরুষ ফিরলেই তবে
সম্পন্ন হবে আনন্দআহার!
চাতকি আকুল রক্তে
উন্মুখ তোলপাড় আজ রুদ্রমহারাত
হ্রদের জিয়ল মাছ আর কোটি কাতলার স্বপ্ন
রশ্মিতরঙ্গে মেতে ওঠে
অগত্যা হে চন্দ্র!
দ্রবিভুত অব্যক্ত এক অপেক্ষার চিরসাক্ষী
তুমিই থেকো মনোরম।
বাকার বর্ণনা
এক.
আছি আরণ্যে, শিয়রে মৃত্যু,
শীতল নিঃশ্বাসে থমথমে চারপাশ
গাছের ডালপালায় দুঃস্বপ্নের পাতা নড়ছে!
দ্রবীভূত পর্বতে ঝাঁপিয়ে পড়ে উপেক্ষার আষাঢ়,
স্বপ্নের চারাবনে দৌড়ায় অদম্য উন্মাদ,
প্রকৃতির গলিত পুঁজে ভরে যাচ্ছে
ইথারের ঝিল!
আর আমি এক দিগন্তবিস্তৃত বৈভব
কোনো মরমি সবুজে-
মানুষের পরাজয় অস্বীকৃতির নানা উপমায়
চাঁদের ঘর-দোরকে করে ফেলি
কবিতার মসনবি!
লবণাক্তনির্জনে বহুবর্ণ কবিতা ঝরায় ছন্দের স্বাদুশীষ,
রমণীরা ক্ষুধার জবাব পাক করতে উনুনে যাকে ভাজে
মৌ মৌ মশলা। বর্তনে তার মাধুরী ঢাললেই বৃক্ষেরা
জ্যোৎস্না, জ্যোৎস্না বলে হেসে ওঠে।
আমার শব্দ তবে পৃথিবীকে জ্যোৎস্না খাওয়াবে?
দুই.
পাপ-পুণ্য আসে, আম্মা আম্মা বলে সেমেটিক বিশ্বাসের
জড়িয়ে ধরি বুক। আয়ুর সর্পের তাড়া, ঔদ্ধত্যের ধমক ভেঙে
আমি তো সেই পাখি, কবরের কঙ্কর ভাসাই হৃদিরন্দ্রের
শরবতে। আলোর পাখা ছড়িয়ে জনতারে টেনে তুলি অসীম ঊর্ধ্বতায়।
সত্যের দাবার গুটি আমি, পৃথিবীতে
চালাচালি হয়, আমাকে তো তিনিই পাঠিয়েছেন। তার মায়া ভুলেছি কভু?
উজ্জ্বল ঘাসের সারি, মেঘের ধুলোবালি প্রগল্ভ দোয়েলের মতো
সাহস সাহস রবে উচ্ছ্বল। নাভির দরজা খোলে কস্তুরিগন্ধ ছড়ায় হরিণী
পুষ্পের সোনালি দুধ অলিরা ছিটিয়ে দেয় আমার চোখে-মুখে
আনন্দের তরঙ্গে থরথর পৃথিবী আকাশ
কিন্তু অদূরেই মৃত্যুর চাবুক ঘুরে সপাং সপাং
তিন.
দুঃসহ হাওয়ার নৃত্য তুমুল গমকে উধাও
আমার মৃত্যুর ছবি নিস্তব্ধ শিলার বুকে গূঢ়জলরং
প্রত্যন্তপাতার গীতে চুইয়ে পড়ে শোকাশ্রু সফেন
বাতাসের ঢেউয়ে ভাসে পর্বতের পাঁজরের গুড়া,
তখনি রক্তে ওঠে বাকার তুফান, শোনিতে গর্জন ওঠে
আনাল হকের। জাগর প্রাণের পাখি উড়ে উড়ে
নিয়ে আসে খুশবু সতেজ
‘খুশবু মাখবো না’ বললাম-‘যাও তরুলতার হাতে হাতে
দিয়ে এসো’ আমি যেনো ধ্যানে রই
আত্মার উৎসবে মৃত্যুর আওয়াজ উঠলে বলবে আমায়
আমি তাকে ছুঁড়ে মারবো সত্তার তীব্রতীর
মৃত্যুর বুকে জীবন তার পা রাখলেই পৃথিবীর বিজয় উৎসব
টিউমার
(এইচ. জি. ওয়েলসকে মনে রেখে)
আমি সীমান্তের সর্বশেষ
পাহাড়ের মাথা থেকে
পা পিছলে পড়ে গেলাম।
গ-ারের শিংয়ের মতো রাগী
পাথরের ধারে রক্তাক্ত আমি
গড়ান খেতে খেতে নেমে এলাম নিচে!
আরেক দেশ।
সীমান্তপ্রহরী।
বন্দুক। মারণাস্ত্র।
চেতনা ফিরে পেয়ে আমি যেই
তাকালাম চারদিকে-
একটি নদী ছিলো সামনে
ছলাৎ ছলাৎ পানি, জীবনের দুধ-
ডাকলো, কাছে আয়!
আমি পান করবো পানি
কিংবা আমাকে পান করবে-
নদীর মাতৃস্নেহ?
গেলাম নদীর কাছে
কে জানতো, নদীতীরে-
ঢিবিভরা উঁইয়ের মতো শিবিরভরা সেনা?
তারা আমাকে গ্রেফতার করলো।
সার্চ করলো;
কোনো অস্ত্র পেলো না
গোপন চিঠি পেলো না
গোয়েন্দাআলামত পেলো না।
তাদের চোখ ছিলো একটি করে। সবার।
তারা নিশ্চিত হলো,
আমি না আগ্রাসন, না মরণাস্ত্র।
তাহলে কেন
আমি
অন্যগ্রহ থেকে
এই গ্রহে চলে এলাম?
আমি কি মহাজাগতিক বিপদসঙ্কেত?
রাজা-উজির
গোয়েন্দা-ডাক্তার
পাদ্রী-পুরোহিত
বিবিসি, প্রথম আলোর টাইমলাইন
এই গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসায়
থরথর করে কাঁপতে লাগলো!
তাদের বুদ্ধিজীবী ছিলো
পেটের আদেশে চলে মাথা!
তাদের দার্শনিক ছিলো
জিজ্ঞাসাকে বন্দি করা যার কাজ!
আমাকে রাজদরবারে নেয়া হলো-
তাদের রাষ্ট্রপ্রধান-এক চোখ!
তাদের বিচারপতি-এক চোখ!
তাদের ধর্মগুরু-এক চোখ!
চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে,
কেন ও কীভাবে আমি নিজের গ্রহ ছেড়েছি!
শেষ অবধি
আবারো তল্লাসী করে
আমার চেহারায়
দেখা গেলো চোখ দু‘টি!
এবং
বুদ্ধিজীবী
ধর্মগুরু
রাজনীতিক
বিচারপতি
সেনাপতি
একমত হলেন-
আমি এক রোগী
কারণ, আমার চোখ দু‘টি!
একটি চোখ, আরেকটি টিউমার!
এ কারণে দেখি কম, পথ ভুলে
ভুল গ্রহে চলে এসেছি!
সদয় মন্ত্রীপরিষদ আমার টিউমার
অপারেশনের নির্দেশ দিয়েছেন!
দুঃসহ রাত্রি এলে
সমুদ্র বললো- না, তোমাকে ঘুমাতে দিলে
উত্তেজিত মাছগুলো শুরু করবে হৈ চৈ
আকাশ বললো- না, তোমাকে বুকে নিয়ে
তারার অবাধ্য ঝড় সামলাতে পারবো না
পাহাড় বললো- ক্ষমা করো ভাই, তোমাকে ধারণ করলে
আমার সুপ্ত লাভা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠবে
অরণ্য, স্থান দেবে শুধু একটি রাতযাপনের
হরিণ বাঘের সাথে আমার মিতালী
চন্দ্র তুমি তো আমার বোন,
জ্যোৎস্নার পাঠি দাও একটু ঘুমাই
দোহাই, উদ্যান তুমি দেবে আজ ঠাঁই?
গোলাপের বুকে বাজে আমার রাগিণী
কেউই দিলো না ঠাঁই
না বোন, না স্বজন, না প্রেমাস্পদ
ঘরদোর নদীনালা, সুহৃদ আপন,
হরিয়াল ঘুঘু টিয়ে, প্রতিবেশী কাক
বাঁশঝাড় জনপদ, আত্মীয় বাগান
দুঃসহ রাত্রি এলে উঠানের নিশিগন্ধাসহ
সকলেই কেমন যেনো অচেনা হয়ে যায় !
আজ রাতে তারাগুলো
আজ রাতে তারাগুলো ঝুলে পড়েছিলো পৃথিবীর তারার বলয়ে
মর্ত্যের চাঁদের টানে বেসামাল হয়ে পড়ে
চাঁদের হৃদয়। ধূলোর উদর ছিঁড়ে বহির্গত হয়েছিলো একঝাঁক শুচিস্নিগ্ধ চারা
হরিৎ উপত্যকায় বাতাস মাতিয়েছিলো স্বপ্ননীল কস্তুরিহরিণ
চোখের ভেতরে তার দুলে উঠেছিলো আকুতির ঢেউ
যেসব মানবশিশু জন্ম নিলো আজ রাতে
তারাও কলকণ্ঠে মুখরিত করেছে পৃথিবীর পাড়া
আজ রাতে বাতাসের বুকে অলৌকিক পাখিগুলো
ডানা মেলে দিলো। দ্রাবিড় দিগন্ত থেকে আত্মার সোনাদানা
খুঁটে খায় তারা
নদীমাতৃক দেশটির কিনারে কিনারে,
মধ্যরাতে জেগে থাকা জনপদের নক্ষত্রের কাছে।
রাখে তারা হার্দিক অভিবাদন
বৃক্ষগুলো কক্ষপথে নক্ষত্রের সহগামী ছিলো
অজানা রহস্যে ঢাকা পড়ে যায় সবুজ পত্রপল্লব
নারকেলের বিনয়াবনত পত্রের মতো সুগভীর বেদনায়
আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে মনের বিস্তার
আজ রাতে নিসর্গের শিরাতন্ত্রীগুলো অপার্থিব
ঢেউ তুলেছিলো। যেহেতু চিরপ্রেমিকের জিকিরমুখর
আজ রাতে পৃথিবীর চাঁদ-তারাগুলো
উদয়াস্তে জ্বালিয়েছে মুগ্ধ মনলেলিহান।
নদী
দর্শনে গন্ধকের নদী
উদয়ের চর হতে ছুটন্ত অফুরন্ত টানে
তরঙ্গে উচ্ছসিত সত্তার নিঃশ্বাস
স্রোতের ভিতরে ঘুর্ণিরা কু-ুলিভাঙা সাপের শব্দে ফুঁসফুঁস
আমি তো ওপারে যাত্রী
ভগ্নআশা ঝড়ের উপর ধাবমান আশার সাঁতার
কবে থেকে ছুটছি মনে নেই অন্ধকারে
কানে শুধু শব্দ বাজে
হয়তো তীর ভাঙার ধ্বনি
হয়তো বা তুফানের রোল
মনে হয় পেরুচ্ছি নদী
মনে হয় ডুবসাঁতারে গিলছি তুফান
এই কী নদী না ঐশ্বরিক উপহাস?
অস্তিত্বের এই ঝড়ে নিমগ্ন নদী তার
জলস্রোত আশার আওয়াজ?
রাতজাগা মানুষের পিছে
ফুটন্ত দীর্ঘশ্বাসগুলো রাতের নদীতে ফেলে দিয়ে
নক্ষত্রকে স্বাক্ষী রেখে সমুদ্রে শয্যা পাতলাম
অমর্ত অরণ্য থেকে ছুটে এলো জ্যোৎস্নার ঘোড়া
তার খুরের দাপটে পালিয়ে গেলো নির্লজ্জ শেয়াল
নতুবা মধ্যরাত এখনো প্রক¤িপত হতো জ্বলজ্বলে চিৎকারে
বিমূর্ত ঘোড়ার কণ্ঠ বেজে উঠলো বাতাসের উর্মীর মতো
সে বললো ওঠো ওঠো একটু পরেই সামুদ্রিক মাইনগুলো
ফেটে পড়বে বর্বরের হাসিতে
সমুদ্র ছেড়ে এসে প্রান্তর, উপত্যকা, জনপদ
নদীনালা, শূন্যের উদ্যানে কড়া নাড়লাম
সর্বত্রই রাতজাগা মানুষের পিছে মাইন ফেটে
বেরিয়ে আসা বর্বরের তাড়া
নতুন দিনের কাব্য
মানুষের হৃদয় অন্ধকারের সর্পিল ছোবলে যন্ত্রণার চুল্লির মতো জ্বলতে
থাকবে আর কতোকাল? আর কতোকাল মানুষের কলজে ছেঁচে
রক্তস্বাদ নিয়ে থাকবে আধারাবৃত মত্ত হায়েনার জিভ?
আর কতোকাল চলবে বর্বরের আধিপত্য, লা¤পট্যের নৃত্য আর বুদ্ধির
ব্যভিচার?
অন্ধ রাত্রি থাকলে পশুপণা থাকবেই
অতএব, পশ্চিম থেকে ধেয়ে আসা অন্ধকারের হৃদয়হীন
দর্শনের বিরুদ্ধে আমরা জ্বালিয়ে দিয়েছি বিশ্বাসের বিদ্যুৎশিখা
নির্জীব রাত্রি সাপের উদরের মতো মৃত্যুগহ্বরে ইতিহাসের
খুরের দাপটে কাঁপছে। একদিকে ঘোষিত হচ্ছে আশা ও আশ্বাসের
আযান, অপরদিকে আকাশের স্তরে স্তরে হতাশার আলকাতরা
সেঁটে দিচ্ছে দুঃসময়ের ক্যানভাসার
মানুষের মুখোশপরা জন্তুর মিছিলে প্রগতির নামে চলছে ইবলিশের শোরগোল
সেই শোরগোল আর কতক্ষণ?
আযানের শব্দগুলো উচ্চকিত হয়ে উঠছে সূর্যের রক্তে জাগা শপথের শিখার মতো
আযানের শব্দগুলো রাশি রাশি জ্যোৎস্নাস্রোতে চারদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে
স্বপ্নীল সুবাতাস, আযানের শব্দগুলো দুর্দম বিদ্রোহে
ঘুমের অরণ্যে জাগায় আত্মার জলপ্রপাত।
সেই জলপ্রপাতের ধারা নতুন ঊষার গন্তব্যে এগিয়ে চলছে
অতএব বন্ধুগণ! সুসংবাদ গ্রহণ করো।
মৃত্যুর বর্ণমালা
আমি হাসলাম। উন্নয়নের গল্পের উপর সওয়ার মহামারিকে
কটাক্ষ করেনি হাসি। কিন্তু তারা চাপিয়ে দিলো
হাসিনিরোধক আইন। জানি, আইনকে যেখানে
যতবেশি পদদলিত করা হয়, ততবেশি
নতুন আইন বানাবার জরুরত। এমনকি
আইনের উপর মূত্র বিসর্জনের আইনও দরকার পড়ে তাহাদের।
হাসতে যখন পারছি না, কবিতা লেখি অন্তত।
কিন্তু আমার শব্দ কেড়ে নেবার আইন ছিলো তাদের পকেটে।
হৃদয়ের কালি, অস্তিত্বের কলমকেও জব্দ করা হলো।
এখন কবিতা লেখবে কেবলই ফ্যাসিবাদ।
ফ্যাসিবাদ কবিতা লেখছে, কাঁপছে টিভির পর্দা।
নাচছে বুদ্ধিজীবী। লাফাচ্ছে শুয়োরের ছানা-বুড়ো।
চারদিকে হৈ হৈ রৈ রৈ!
কবিতা রচিত হলো বটে। কিন্তু তার ছন্দের নাম পদদলন,
প্রতীকের নাম গুম, উপমার নাম পাচার, উৎপ্রেক্ষার নাম রাহুগ্রাস,
যমকের নাম জুলুম, অনুপ্রাসের নাম করাপশন
চিত্ররূপের নাম অধিকারনাশ এবং অর্থালঙ্কারের নাম
বিরতিহীন লুটপাট!
গোলাম কবিদের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে
ফ্যাসিবাদ কবিতামঞ্চে এলেন: মহান কবিতা পড়বেন তিনি।
কবিতাটি পড়া হচ্ছে বটে! কিন্তু
মৃত্যুর বর্ণমালা ছাড়া কবিতাটি কিছুই বলছে না।
সেজদা
রাতের তৃতীয় প্রহর।
হজ্বের গিলাফ গায়ে জড়ানো চাঁদ প্রস্তুতির গোসল সেরে
কুরবানির দুম্বাদের সাথে আকাশে পায়চারি করছে।
আমি তিনজন গাছের সাথে একান্ত আলাপ সেরে হঠাৎ উপরে তাকালাম।
চাঁদের শরীর বেয়ে গোসলের ফোটা ফোটা দুধ ঝরে পড়ছে।
উড়ন্ত চুমু দিয়ে সে আমাকে স্বাগত জানালো। চাঁদকে ধন্যবাদ জানিয়ে
মহাশূন্যে বিশেষ আসরে যাত্রা করলাম।
কেমন আয়োজন ছিলো? জানতে চেয়ো না।
পাহাড়,নদী-নালা,বৃক্ষ, পশু- পাখি সকলেই যার যার মতো উপস্থিত ছিলেন।
সময় সেখানে ছিলো আরেক সময়
দিন- রাতের অতিরিক্ত কিছু!
স্থানের সেখানে ছিলো ভিন্ন মানে
আয়তন বা আকারের অধিক কিছু!
সেখানে প্রমাণ করতে হচ্ছিলো অস্তিত্বকে।
কারণ অস্বীকার করা হচ্ছিলো আমার অস্তিত্ব!
বললাম –
‘আমি যদি না থাকতাম, তবে কেন আপনারা প্রশ্ন করছেন- আমি কে?’
‘যারা জানতে চান আমার অস্তিত্ব, সবার ভাবনায় আমি আছি।
আমার অস্তিত্বকে যারা অস্বীকার করছেন
তাদের মধ্যে যেমন আছি, তেমনি যারা স্বীকার করছেন, তাদের মধ্যেও আছি!’
‘আমাকে যে প্রমাণ করতে হচ্ছে আমার থাকা, এটাই আমার থাকার প্রমাণ!’
‘আমার সবকিছুর মধ্যে নিহিত আছে আমার সবকিছুর কারণ।’
বলা হলো,তোমার দৃশ্যমান প্রমাণ পেশ করো।
আমি একটা পাহাড় বানালাম।
পাহাড়টি বানালাম,যেন পাহাড়ের বাইরে না থাকি!
যেন সকলেই পাহাড় দেখে আমাকে দেখতে পায়!
পাহাড় নিজেকে দিয়ে আমাকে প্রমাণ করছিলো।
এখানেই শেষ হতে পারতো কবিতাটি।
বিপত্তি বাড়ালো হাওয়া। বললো, তুমি বাহ্যিক বাস্তবতাকে প্রমাণ করেছো।
বাস্তবতার সারবস্তুকে প্রমাণ করোনি।
বললাম, আমার বাস্তবতার সারবস্তু প্রত্যক্ষণের উর্ধ্বে।
সে সকল চেতনার চেতনাতিরিক্ত প্রাণ।
নদী বললো, তাহলে তুমি নিজেকে প্রমাণ করতে পারোনি।
কারণ সৃষ্টি দিয়ে নিজেকে কেবল গৌণভাবে প্রমাণ করা যায়।
আমার বোয়াল মাছ আমার অস্তিত্বকে প্রমাণের জন্য যথেষ্ট নয়।
কারণ সে হতে পারে হাওরের বোয়াল।
পরম অস্তিত্বে নিজের অস্তিত্বকে প্রমাণ করো।
আমি এর জবাবে
সেজদায় লুঠিয়ে পড়লাম।
জায়গাটি কেমন ছিলো,জানতে চেয়ো না।
কতকাল অতিক্রান্ত হলো,জানতে চেয়ো না।
অস্তিত্বের মোহনায় আমি তাৎপর্যের মধ্যে ডুবে আছি।
আকাশগঙ্গা বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে আছে।
নীহারিকা আমার সারসত্তাকে জানাচ্ছে সালাম।
সৌরলোকে পড়ে গেছে অভূত সাড়া।
নিসর্গের গোটা মাহফিল মহাঅস্তিত্বে আমার নিমজ্জন থেকে পান করছে মুগ্ধতা।
সবাই অপেক্ষমাণ। আমি কখন মাথা তুলি।
আমার অস্তিত্বকে সবাই উদযাপন করবে!
কিন্তু আমি যেহেতু নিজেকে লুঠিয়ে দিয়ে অস্তিত্বে জেগে উঠেছি,
অতএব আমার কোনো দরকার নেই নিজেকে প্রমাণ করার।
আমার কোনো গরজ নেই মহাবিশ্বের হর্ষধ্বনির।
আমি যে রহস্যস্বাদে নিজেকে আবিষ্কার করেছি
সেই সেজদা থেকে তোমাদের খোঁড়া প্রমাণ
দর্শন ও অভিবাদনের ভেতর মাথা তুলবো না।
আমার সেজদাই শেষ অস্তিত্বদর্শন!