আড্ডাপত্র

২৬ ফাল্গুন, ১৪৩১; ১১ মার্চ, ২০২৫;সকাল ৯:১৭

আড্ডাপত্র : প্রথম কাব্যগ্রন্থ, প্রথম কবিতা– ১৬

প্রথম কাব্যগ্রন্থ, প্রথম কবিতা আড্ডাপত্র প্রকাশ করছে। প্রথম কাব্যগ্রন্থের সাথে কবির আনন্দ, উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি পাঠকের কানে নতুন কবিতার গুঞ্জরণ ভেসে আসে। পাঠকের মনে কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতাটি তুলে ধরতে চায় আড্ডাপত্র। কবিতা পাঠের সাথে সাথে জানবো কবি সম্পর্কেও। এই আয়োজনটি পরবর্তীতে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হবে…

অবিশ্বাস্য
আবু হেনা মোস্তফা কামাল

মাঝে মাঝে কী যে হয়, আমার সামান্য হাতে থরথর
কাঁপে ছড় পৌঢ় মেনুহিন বিরামবিহীন বাজে
অলৌকিক রেকর্ড প্লেয়ারে, অদৃশ্য ঝর্ণার স্বর বিবর্ণ দেয়াল, মেঝে,
রুগ্ন শেলফ্ ছুঁয়ে যায়, কী যে হয়, দৈনন্দিন দুঃখের কোরাসে
কে করে নিপুন চালে আনন্দের কারুকাজ? তাকে
কোথাও দেখি না, তবু আকাশ তো নীল হয়, পাতারা সবুজ হয় না জেনেই,
না জেনেই একদিন তোমার শরীর উন্নীলিত, উন্মথিত হয়, না জেনেই
একদিন কী যে হয়, আয়নায় নিজেকে দেখি অবিশ্বাস্য নতুন অচেনা।

আবু হেনা মোস্তফা কামাল শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, গীতিকার, গবেষক। আবু হেনা ১৯৩৬ সালের ১১ মার্চ পাবনা জেলার উল্লাপাড়ার গোবিন্দা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
তিনি ১৯৫২-তে পাবনা জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক ও ১৯৫৪-তে ঢাকা কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে ত্রয়োদশ স্থান এবং আইএ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে সপ্তম স্থান অধিকার করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৮ সালে বাংলায় বিএ অনার্স এবং ১৯৫৯ সালে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। স্নাতক(সম্মান) ও স্নাতকোত্তর উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন।
কলেজে শিক্ষকতার মাধমে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। ১৯৬২ সালে তিনি জনসংযোগ পরিদপ্তরে সহকারী পরিচালক পদে যোগদান করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে লেকচারার হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি বাংলা বিভাগের সিনিয়র লেকচারার হয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। তিনি ১৯৬৬ সালে কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে উচ্চতর গবেষণার জন্য লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে The Bengali Press and Literary Writing – (1818-1831)’ শীর্ষক অভিসন্দর্ভ রচনা করে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক পদে যোগ দেন। ১৯৭৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে অধ্যাপক পদে যোগদান করেন। ১৯৮৪ সালে তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী এবং ১৯৮৬ সালে বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক নিযুক্ত হন।
ছাত্রজীবন থেকেই আবু হেনা ছিলেন সংস্কৃতিপ্রেমী। নিয়মিত লিখতেন কবিতা আর গান। স্বদেশপ্রেম, মানবপ্রেম, হৃদয়ের অন্তরঙ্গ অনুভূতি, গভীর আবেগ সব মিলিয়ে আধুনিক শিল্প চর্চার এক পরিশিলিত রূপের দেখা মেলে তার কবিতা আর গানে। ‘তুমি যে আমার কবিতা’, ‘অনেক বৃষ্টি ঝরে’, ‘নদীর মাঝি বলে’, ‘অপমানে তুমি জ্বলে উঠেছিলে সেদিন বর্ণমালা’,‘এই বাংলার হিজল তমালে’র মত অনন্য সৃষ্টি রয়েছে আবু হেনা মোস্তফা কামালের। প্রবন্ধ, সমালোচনা, গবেষণাধর্মী লেখা সাহিত্যের এই ক্ষেত্রেও ভাষা শৈলী, বক্তব্য উপস্থাপন রীতি, রসবোধ ও অনুভূতির বহিঃপ্রকাশে আবু হেনা স্বাতন্ত্র্য। পঞ্চাশের দশকে ঢাকাকে কেন্দ্র করে সাহিত্য ও সংস্কৃতির যে নতুন ভুবন তৈরি হচ্ছিল, আবু হেনা ছিলেন সে পরিবৃত্তের তরুণ সদস্যদের একজন। ছাত্রাবস্থা থেকেই তিনি সংস্কৃতিসেবী হিসেবে সুনাম অর্জন করেন। মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ সহযোগে আবু হেনা ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলার কবিতা নামে একটি সঙ্কলনগ্রন্থ প্রকাশ করেন। তরুণ বয়সে কবি ও গীতিকাররূপে তাঁর সফল আত্মপ্রকাশ ঘটে। বন্ধু আবু বকর খান, আনোয়ারউদ্দিন খান ও মোঃ আসাফদ্দৌলাসহ তিনি আধুনিক গান চর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্মিলন গড়ে তোলেন। আবু বকর খানের গাওয়া বিখ্যাত গান ‘সেই চম্পা নদীর তীরে’ আবু হেনারই লেখা। তিনি ঢাকা বেতারের নিয়মিত শিল্পী ছিলেন। অন্তরঙ্গ অনুভব, গাঢ় আবেগ, রোমান্টিক আর্তি এবং কখনো কখনো স্বদেশবোধের শিল্পিত পরিচর্যা তাঁর কবিতা ও গানগুলিকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। তিনি একই সঙ্গে কবি ও গীতিকার হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। তিনি ছিলেন বাংলা গানের উজ্জ্বল গীতিকার, টেলিভিশনের বাককুশল রসিক উপস্থাপক ও আলোচক।
গদ্যচর্চায় আবু হেনার সৃষ্টিশীলতার নিদর্শন রয়েছে। সাহিত্যপাঠের ব্যাপকতা, সাহিত্যবোধের রসঘনতা এবং ভাষাপরিচর্যা তাঁর গদ্য রচনায় স্বতন্ত্র স্বাদ সৃষ্টি করেছে। প্রবন্ধ, গবেষণাধর্মী লেখা, সমালোচনা, ভাষ্য-সব ধরনের গদ্য রচনার বক্তব্য, ভাষা, উপস্থাপনা ও ভঙ্গিতে তাঁর স্বকীয়তা সুস্পষ্ট। আবু হেনা বাংলা সাহিত্য ও বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের মূল্যায়ন করে কিছু উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ লিখেছেন এবং সেগুলি তাঁর শিল্পীর রূপান্তর এবং কথা ও কবিতা নামের দুটি প্রবন্ধ-সংকলনে স্থান পেয়েছে। বাংলাদেশের সাহিত্য-সমালোচনায় তাঁর এ গ্রন্থদুটি বিশিষ্টতার দাবি রাখে।
আবু হেনার তিনটি কাব্যগ্রন্থ আপন যৌবন বৈরী (১৯৭৪), যেহেতু জন্মান্ধ (১৯৮৪) ও আক্রান্ত গজল (১৯৮৮) এবং আমি সাগরের নীল (১৯৯৫) তাঁর গানের সংকলন। আবু হেনা মোস্তফা কামালের ইংরেজিতে লেখা গবেষণাগ্রন্থটি হলো The Bengali Press and Literary Writing. এটি উনিশ শতকের কলকাতায় বাংলা সাময়িকপত্রে প্রকাশিত সাহিত্যবিষয়ক রচনা সম্পর্কে গবেষণামূলক আলোচনা। তিনি একসময় সাময়িক পত্রিকায় সাহিত্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক সরস কলাম লিখে প্রশংসিত হন।
কাব্যগ্রন্থ: আপন যৌবন বৈরী (১৯৭৪); যেহেতু জন্মান্ধ (১৯৮৪); আক্রান্ত গজল (১৯৮৮)
প্রবন্ধ-গবেষণা: শিল্পীর রূপান্তর (১৯৭৫); দি বেঙ্গলি প্রেস অ্যান্ড লিটারারি রাইটিং (১৯৭৭); কথা ও কবিতা (১৯৮১)
পুরস্কার: আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭৫); সুহৃদ সাহিত্য স্বর্ণপদক (১৯৮৬); একুশে পদক (১৯৮৭); আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ স্বর্ণপদক (১৯৮৯); সা’দত আলি আখন্দ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯১)
তিনি ১৯৮৯ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। আবু হেনা মোস্তফা কামালের পুত্র সুজিত মোস্তফা একজন নজরুল সংগীত শিল্পী, সংগঠক ও গবেষক।
তথ্যসূত্র: বাংলাপিডিয়া
উইকিপিডিয়া

Facebook Comments

আড্ডাপত্রে লাইক দিন

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১১৩১৫
১৬১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭
৩০৩১