আড্ডাপত্র

৬ কার্তিক, ১৪৩১; ২২ অক্টোবর, ২০২৪;দুপুর ১:৩৫

গণঅভ্যুত্থানের কবিতা : পর্ব ৫

আড্ডাপত্র

অক্টো ১১, ২০২৪ | কবিতা, গুচ্ছ কবিতা

দীর্ঘ দীর্ঘতর জুলাই

কামরুজ্জামান

ঘুমাতে পারিনা জুলাই’র রাতগুলো হীম
হয়ে আসে শরীর হৃৎপিণ্ড অস্থি মজ্জা
অজস্র গুলির শব্দের আঁধার কালো
পঁচিশে মার্চের কথা স্মরণে আসছে যেনো।
টিনিট্রন ফ্যাল্ট স্ক্রিনে ছড়িয়ে যাওয়া রক্ত স্রোত
এত রক্ত কোনদিন কেউ দেখেনি এভাবে স্বাধীন স্বদেশে
কত দ্রুত লাফিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর পরিসংখ্যান।

প্রথম সাহসী যুবক আবু সাঈদ রঙপুরে
ইতিহাসের মহা নায়ক, যাকে খুব কাছ থেকে
গুলি করে হত্যা করা হলো প্রকাশ্য দিবালোকে
নির্মম নির্দয় পৈশাচিকতায় স্তব্ধ হয়ে
আসে বোধ, দরিদ্র কৃষকের সন্তান রক্ত দিয়ে
মর্ম মূলে আঘাত করে জাগিয়ে দিয়েছে জাগো –
জাগো লক্ষ কোটি জনপদে বাংলার তরুণী তরুণ নওজোয়ান…

ঢাকার উত্তরায় পানি লাগবে পানি বলে দ্বীপ্ত স্বরে
ছুটে বেড়াচ্ছিল অসামান্য হৃদয়বান যুবক মুগ্ধ
গুলি টিয়ারস্যাল উপেক্ষা করে এগিয়ে যাচ্ছিল সে
মাথায় গুলি করে হত্যা করা হলো তাকে আচানক
সাতানব্বইটি হেলিকপ্টার উড়ালো আকাশে
জনসাধারণের ট্যাক্সের টাকায় নির্বিচারে গুলি
সাউণ্ড গ্রেনেডে নয়া মাটি মহল্লায় উম্মুক্ত ছাদে
পিতার কোলে মাথায় বুলেট বিদ্ধ হলো শিশু রিয়া মনি…
নিপুণ লক্ষ্যবিদ স্নাইপার লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে
গুলি করে করে নিবিয়ে যাচ্ছে শত শত জীবন প্রদীপ।

দীর্ঘ দীর্ঘতর আরো দীর্ঘ হয়ে উঠলো জুলাই
রক্তে রক্তে গাঢ় প্রগাঢ় হলো দেখি যেনো
পতাকার লাল সূর্য সহস্র সহস্র শহীদের খুনে খুনে
প্রলম্বিত হয়ে চলেছে জুলাই রক্তের বন্যায়
মর্গ গুলো উপচে পড়েছে লাশে লাশে নামছে রক্ত স্রোত
একত্রিশে জুলাই বত্রিশে জুলাই তেত্রিশে জুলাই
চৌত্রিশে জুলাই পয়ত্রিশে জুলাই ছত্রিশে জুলাই…

রক্তের স্রোত থামেনি এখনও প্রতিদিন শুনি
মৃত্যুর সংবাদ গুলিবিদ্ধ মুমূর্ষু আছে যারা নিবিড় পর্যবেক্ষণে
শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করছে স্বৈরাচার মুক্ত বাংলাদেশে।

গণজোয়ার

ফজলুল হক তুহিন

পূঞ্জীভূত মেঘের ভেতর অনেক খরার ক্ষোভ গর্জনের জন্য একত্রে প্রস্তুত
পৃথিবী কাঁপিয়ে বাঁক ফেরার বর্ষণে আজ প্লাবনের নতুন আশ্বাস।

তাই বুঝি চারদিক আগ্নেয় লাভার মতো সুনামির মতো গণজোয়ারের বাঁধভাঙা ঢেউ
আছড়ে পড়েছে রাজপথে ফুটপাতে অলিতে গলিতে

মায়ের আদর সবুজের সমারোহ বন্ধুদের আড্ডা-
সব ভুলে আবু সাঈদের হাত দুটি
হয়ে গেছে দোয়েলের ডানা- অলৌকিক ডানার উড়াল
বুক তার বাংলাদেশের রক্তাক্ত পতাকা!

চেয়ে দেখো সমস্ত সড়ক এভিনিউ গণমিছিলের পদভারে শ্লোগানমুখর
আগামীর আলোক রেখায় চোখ রেখে প্রতিটি কিশোর তরুণ
যুবক নারী শিশু বৃদ্ধ- জনতা-হৃদয়ে উন্মুখ বারুদ
পদাতিক দাবানল হয়ে জ্বলে উঠেছে আবার!

পলাশ বিছানো ঘাসে হাঁটতে হাঁটতে
রুদ্ধশ্বাস আবহে বাঁচার অসম লড়াই করতে করতে
খাঁচার জীবন গ্লানির আঁধারে বইতে বইতে
যখন দেয়ালে পিঠ বিষাক্ত পেরেকে বিদ্ধ
তখন হঠাৎ যুবজোয়ারের স্রোতে জনরোষে অধিকার ফিরে পাওয়ার
গগনবিদারি শ্লোগান যেন বিপ্লবের পদধ্বনি!

অতঃপর রাক্ষুসের নখের বিস্তার-
লেফট রাইট ফায়ার বুলেট রক্ত গণহত্যা ধ্বংস কান্না শোক
বিধবার শাড়ি আর কাফনের রঙ একাকার হয়ে স্তব্ধতা এসেছে নেমে-
রাজপথ থেকে গণমানুষের নগরে বন্দরে গঞ্জে গ্রামে।

মায়ের কান্নার সুর দূরে শোনা যায়
ক্ষোভের বারুদে জানি আবার জ্বলবে দেশলাই।

পানি লাগবে কারোর পানি পানি

জাহানারা বুলা

চলে এসো মুগ্ধ, তোমাকে মা ডাকছেন
তোমার মায়ের যে ভুলগুলো হতো দুই সন্তানের অবিকল-
এক-ই অবয়ব বলে সেই ভুলগুলো ভীষণ প্রশান্তির ছিলো
তিনি সেই ভুলগুলো ফিরে পেতে চান
আকাশের দিকে দুহাত তুলে তাই মুনাজাত করেন।
একা একা ভাইটি তোমার
শুধু স্নিগ্ধতায় মনোমুগ্ধকর আবেশ পায় না খুঁজে
পাশাপাশি বিছানা, দুটি পড়ার টেবিল, টেবিলের ল্যাপটপ-
সবই এখন তোমার মতো স্লিপমোডে স্তব্ধ অসাড়।
বারান্দার রেলিঙে উবু হয়ে দাঁড়িয়ে সে অপেক্ষা করে
তোমার হঠাৎ চলে যাওয়ার প্রশ্নগুলো-
তাকেও ভাবায় তোমার’ই মতো
তোমরা যে মনোজাইগোটিক টুইন-
দুটি দেহে একই আত্মার বসবাসের বন্ধুত্ব যেমন
তুমি জানো না তোমার অপরাধ
তেমনি স্নিগ্ধও জানে না কিছুই।
এলোমেলো পড়ার টেবিল, কিবোর্ড, মাউস প্যাডে
গিটারের শরীর জুড়ে জমে থাকা ধূলো,
আলুথালু বিছানা বালিশ গোছাতে চান না মা
তোমার উপস্থিতি, তোমার মিষ্টি হাসি যে গড়াগড়ি করে-
সেই সব সংগ বদ্ধ ধূলিকণায়- ঝাড়ামোছায় বিরতি এখন।
মা আর স্নিগ্ধ চাইলেও ভাবতে পারছে না- তুমি নেই
কেননা তুমি আছো মায়ের আঁচলে হাতমোছা গন্ধে
চায়ের কাপে, ভাতের থালায়, খাবার টেবিল-চেয়ারে।
সময় কাটে না স্নিগ্ধ’র, মন ভালো নেই
তবুও টিভির পর্দায় অথবা মোবাইল টিপে
ইউটিউব দেখে না সে আর
কেননা শুনতে চায় না সে তোমার বলা শেষ কথার-
“পানি লাগবে কারোর, পানি, পানি”র মতো জীবন দায়িনী-
প্রতিশ্রুত শব্দগুলো
অশ্রু ধারায় বিদায় জানাবে কতোবার তোমাকে বলো?

রিটার্ন অব ওজিম্যান্ডিয়াস

জাহিদ নয়ন

রক্ত-ফিনকি ছুঁয়ে গেছে পাললিক উপত্যকার স্রোত
আউশ ধানের গন্ধ মাখা মেঠোপথে বারুদের উত্তাপ!
পাখিদের টুটি চেপে আছে উন্মত্ত শকুন
সান্ধ্য ভোজের সূচনা সংগীত-বন্য কোরাসে।

পুনরুত্থানে জেগেছে ক্ষীয়মান অন্ধ নগর;
পথে পথে প্রহরায় জীবন্ত প্রমিথিউস!
শহরতলীর বুকে জুড়ে উড়ন্ত আবাবিল
পরোয়ানা হাতে সাক্ষাৎ অসুরের মৃত্যুদূত!

নির্ঘুম জোনাকি বিপন্ন বাতাসের বিবর্ণ আশ্বাসে
জেগেছে আহত পাখি সময়ের সুবর্ণ প্রশ্বাসে।

সরণির বুকে জ্বলছে জীবন্ত ভিসুভিয়াস ;
তবু দাম্ভিক উচ্চ শিরে দাঁড়িয়ে আছে –
বেপরোয়া পরাক্রমশালী ওজিম্যান্ডিয়াস!

দ্বি তী য় স্বা ধী ন তা

কাব্য রাসেল

জানুয়ারির গর্ভ থেকে জন্ম নেয়া নিষ্পাপ জীবনের মতো বেরিয়ে আসে নতুন অধ্যায় এরপর লেখা হতে থাকে ইতিহাসের পাতায়।
অতঃপর দীর্ঘ শোষণ-নিপীড়নের পর জেগে উঠতে চায় জনতা। আমাদের কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা ভাবনার সিঁড়িগুলো ভাঙ্গতে থাকে ক্রমাগত। আমরা উপলব্ধি করতে থাকি বিপ্লবের চেতনা, খুঁজতে শুরু করি বিদ্রোহের পথ, ভাঙতে শুরু করি সমস্ত শৃঙ্খলতা। এরপর লক্ষ লক্ষ আত্মত্যাগ ও বিসর্জনের পর আমরা পাই প্রথমবারের মতো
একটি মানচিত্র,
একটি পতাকা,
একটি স্বাধীনতা!
এরও পরে
দীর্ঘ ৫৩ বছরের ক্যারিয়ারে বাংলাদেশে শেষ আঘাত এসে লাগে সেই শোষণ-নিপীড়নের নতুন মুখোশের পরাধীনতার থাবা। শুরু হয় আবার আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প এক সৈরশাসকের বিপক্ষে। শুরু হয় আবার ছাত্র-জনতার এক দুঃসাহসিক যুদ্ধ শত শত প্রাণের বিনিময়ে। এরপর লেখা হয় নতুন ইতিহাস যার নাম, ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’!

Facebook Comments

আড্ডাপত্রে লাইক দিন

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১
১৩১৫১৬১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭৩০৩১